Wednesday, January 17

বিশেষজ্ঞদের মতে, রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিপক্ষে প্রচারণা অধিকারবিরুদ্ধ

রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচারণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশের কট্টরপন্থী কিছু আলেম। তাঁরা হিজড়াদের অধিকার সমর্থন করলেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন “আল্লাহর সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপের শামিল” বলে মনে করেন।

রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য সম্প্রতি ‘জাতীয় ফতোয়া বোর্ড’ নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবারের পর সংগঠনটির একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন মুফতি মীজানুর রহমান সায়ীদ।

তিনি বলেন “আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন আমাদের যে পরিচয়ে সৃষ্টি করেছেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার পরিবর্তন ঘটানো আল্লাহর সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপের শামিল।”

তিনি বলেন, আল্লামা মাহমুদল হাসানকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ১৭ সদস্যের ওই বোর্ডের সদস্য সচিব মুফতি আব্দুল মালেক ও তিনি এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করতে যাচ্ছেন।

লিঙ্গ রূপান্তর কেন “কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী তা নিয়ে বিস্তারিত” আলোচনাভিত্তিক ওই বইটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশ জুড়ে বিতরণ করা ছাড়াও এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারণামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে বলে জানান মুফতি মীজান।

তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু হিজড়াদের অধিকার নিয়ে সচেতন। আমরা মনে করি, যেহেতু আল্লাহ তাদের হিজড়া হিসেবে সৃষ্টি করেছেন সেহেতু যে অধিকার সমাজে তাদের প্রাপ্য, তা অবশ্যই তাদের পাওয়া উচিত। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত লিঙ্গ) ও হিজড়া একই বিষয় নয়। ট্রান্সজেন্ডার আল্লাহর সৃষ্টির ওপর সরাসরি হাত।”

এর আগে গত ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার পাঁচ জন মুফতি ট্রান্সজেন্ডার মতবাদকে “অভিশপ্ত ও হারাম” আখ্যা দিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছেন।

বাংলাদেশে জন্মসূত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনগত অধিকার ভোগ করে থাকেন। যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করেন তাঁরা রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত।

বৈশ্বিকভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বলতে হিজড়া ও রূপান্তরিত লিঙ্গ উভয়কে বোঝালেও বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যারা লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তন করেন তাঁদেরকেই ট্রান্সওমেন বা ট্রান্সম্যান (রূপান্তরিত নারী বা পুরুষ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় বলে বেনারকে জানান ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া কমিউনিটির অধিকার নিয়ে কাজ করা রূপান্তরিত নারী তানিশা ইয়াসমিন চৈতি।

তিনি বলেন, সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের আইনি অধিকার নিয়ে একটি কাজ করছে, তা চূড়ান্ত হলে রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের সংজ্ঞাগত সমস্যা দূর হবে বলে আশা করা যায়।

দেশের আলেম সমাজ এমন এক সময় ট্রান্সজেন্ডারদের বিরুদ্ধে প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে, যখন সম্প্রতি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলাম নিজের হিজড়া পরিচয় প্রকাশ করেছেন।

তিনি অভিযোগ তুলেছেন, সম্প্রতি তাঁকে মারাত্মকভাবে বুলিং বা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বর্তমানে তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ওয়ালিদ দেশের প্রথম হিজড়া কূটনীতিক।

ফেসবুক পোস্টে ওয়ালিদ বলেন, “৩৪ বছর ধরে যে মানুষটা আইডেন্টিটি লুকিয়ে বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে আসছে তাঁর কি উচিৎ নয় লুকোচুরি না খেলে সবকিছু খুলে বলা?”

এর আগে গত মাসে ঢাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে নিমন্ত্রিত হয়েও একটি গোষ্ঠীর আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত সেখানে বক্তব্য দিতে পারেননি ট্রান্সজেন্ডার নারী হো চি মিন ইসলাম।

বেসরকারি সংগঠন হিরোজ ফর অল ও আইসোশ্যাল আয়োজিত ‘উইমেনস ক্যারিয়ার কার্নিভ্যাল-এক্সপ্লোর ইয়োর ফিউচার উইথ আস’ এর একটি সেশনে হো চি মিন ইসলাম বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন।

হো চি মিন ইসলামের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে আয়োজক সংস্থাও শেষ পর্যন্ত তাঁকে অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্মমন্ত্রী মো: ফরিদুল হক খান বেনারকে বলেন, মুফতি বোর্ড গঠন ও রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রচারণার উদ্যোগ বিষয়ে তিনি অবগত নন।

তিনি বলেন, “এসব বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে মন্তব্য করতে চাই না।”

ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার সুরক্ষায় গত বছর একটি উদ্যোগ নিয়েছে সমাজসেবা অধিদফতর।

ওই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক মোঃ শাহ জাহান বেনারকে বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য এবং তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ভূমির মালিকানা বিষয়ে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।”

এই প্রচারণা অধিকার বিরুদ্ধ

রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের প্রচারণাকে অধিকার বিরুদ্ধ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা।

“দেশের মানুষ, সমাজ যখন আমাদেরকে গ্রহণ করতে শুরু করেছে সেই সময় এমন একটি উদ্যোগ সত্যিই হতাশাজনক,” বেনারকে বলেন ২০১১ সালের ট্রান্সজেন্ডার নারীতে পরিণত হওয়া তানিশা ইয়াসমিন চৈতি।

ট্রান্সজেন্ডারের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির ওপর হাত দেয়া হয়, আলেমদের এমন দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, “জন্মের সময় যদি মানুষ কোনো একটা অসুস্থতা নিয়ে জন্মায় তার কি চিকিৎসা করা যাবে না? তাহলে জেন্ডার সংক্রান্ত অসুস্থতাকে সারিয়ে তুললে সেটা কেন পাপ হবে?”

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বেনারকে বলেন, “প্রথমত, আমার ধর্মীয় জ্ঞান বলে, এটা কোনো বিবেচনাতেই ধর্মবিরোধী কাজ নয়। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি কারো অধিকার খর্ব করার জন্য যে প্রচারণা হয়, সেটাই বরঞ্চ বন্ধ হওয়া জরুরি।”

বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে সকল নাগরিক “আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।”

“সংবিধানের এমন নির্দেশনার পরও যারা এর বিরুদ্ধাচরণ করছেন, তারা রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করছেন। এটা হওয়া উচিত নয়, কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না,” বলেন তিনি।

সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। তবে চৈতি মনে করেন, দেশে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার মিলিয়ে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম নয়।

বাংলাদেশে রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই।

No comments:

Post a Comment