Monday, January 15

বাংলাদেশে এলজিবিটি এজেন্ডার নেপথ্যে কারা?

ট্র্যান্সজেন্ডার নিয়ে কাজ করার আরও একটি সুবিধা ছিল। উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হিজড়া নামক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আছে। সমাজে তাদের একধরনের পরিচিতি ও স্বীকৃতি আছে, আছে তাদের প্রতি সহানুভূতিও। ফলে হিজড়া আর ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দদুটোকে এক সাথে ব্যবহার করে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে কাজ করা তুলনামূলকভাবে সহজ।


২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে এলজিবিটি নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বুঝতে পারে সরাসরি সমকামী অধিকারের দাবি তুলে এখানে আগানো কঠিন হবে। তারা কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। সামনে আনে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ এবং যৌন শিক্ষাকে। এই পরিবর্তনের আরো কিছু কারণ ছিল।

২০১৫ তে অ্যামেরিকায় ‘সমকামী বিয়ে’ বৈধ হয়ে যাবার পর থেকে পশ্চিমা দাতারা ক্রমেই ট্র্যান্সজেন্ডার সংক্রান্ত কর্মকান্ডে ফান্ড দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দাতারা যৌন শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বিকৃতির স্বাভাবিকীকরণে অর্থায়নও শুরু করে। তাই দেশীয় এনজিও-গুলোও ঝুকতে শুরু করে এদিকে।


অন্যদিকে যৌন বিকৃতির সামাজিকীকরণ এবং বৈধতার জন্য শিক্ষার ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। শিশুকিশোরদের মাথায় শুরুতেই যদি ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে মানুষ ইচ্ছেমতো যৌন সঙ্গী বেছে নিতে পারে, ইচ্ছে মতো যৌনতায় লিপ্ত হতে পারে, নিজের পরিচয় বেছে নিতে পারে ইচ্ছে মতো – সবই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকারের বিষয় -তাহলে এক প্রজন্মের মধ্যেই সমাজের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় ধরনের অবনতি নিয়ে আসা সম্ভব।

দেশীয় এনজিও এবং এলজিবিটি সংগঠনগুলো তাই সামাজিক প্রেক্ষাপট, দাতাদের পছন্দ, কৌশল মূল্যায়নসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এবং যৌন শিক্ষাকে সামনে রেখে এলজিবিটি মতবাদের প্রচার, প্রসার ও সামাজিকীকরণে মনোযোগী হয়। আর এজন্য তারা কাজে লাগায় হিজড়া ও তৃতীয় লিঙ্গ শব্দাগুলিকে।



হিজড়া নিয়ে অ্যাকটিভিসম:

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এনজিওগুলো যখন এইডস নিয়ে কাজ শুরু করে তখন কাজ শুরু হয় হিজড়া সম্প্রদায় নিয়েও। ২০০০ সালে কেয়ার বাংলাদেশের অর্থায়নে বাঁধন হিজড়া সঙ্ঘ নামে একটি এনজিও গড়ে ওঠে। পরের বছর হিজড়াদের নিয়ে কাজ করার জন্য সুস্থ জীবন নামে একটি এনজিও তৈরি করে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।[1] ২০১০ নাগাদ হিজড়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এনজিওগুলোর কাজ ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। এমনকি হিজড়া এবং তাদের নিয়ে কাজ করা ‘সুশীল সমাজ’ এর মধ্যে ‘এনজিও হিজড়া’ নামে একটা নামই চালু হয়ে যায়।[2] তবে এসব এনজিও-র মাধ্যমে হিজড়া সম্প্রদায়ের লাভ কতোটুকু হয়েছে তা নিয়ে আছে মিশ্র অনুভূতি। হিজড়াদের অনেকে মনে করেন এনজিও চালানো লোকেরা প্রচুর টাকা কামিয়ে নিলেও গরীব হিজড়াদের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।[3]

২০০৭ সালে ব্র্যাকের উদ্যোগের পর হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো যৌন স্বাস্থ্যের বদলে ‘অধিকার’ এর আলাপের দিকে ঝুকে পড়ে। এ সময়টাতে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি দেয়ার দাবি ওঠে। এই দাবির পেছনেও মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক এলজিবিটি নেটওয়ার্ক। তারা হিজড়াদের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। ২০০৭-এ নেপালে এবং ২০০৯-এ পাকিস্তানের পর, ২০১৩ সালে বাংলাদেশেও হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দেশীয় এনজিও, তাদের বিদেশী ডোনার এবং এলজিবিটি আন্দোলন এই স্বীকৃতিকে দেখে নিজেদের সাফল্য হিসেবে।

২০১৫ সালে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উদ্যোগে ঢাকায় ব্যাপক জাকজমকের সাথে হিজড়া প্রাইড নামে মিছিল আয়োজন করা হয়। প্রাইড প্যারেড বা প্রাইড মিছিলের ধারণাটা সরাসরি অ্যামেরিকান ও পশ্চিমা এলজিবিটি আন্দোলন থেকে আসা।[4] হিজড়া প্রাইডে হিজড়াদের পাশাপাশি দেখা যায় বিভিন্ন পশ্চিমা দূতাবাস আর দাতা সংস্থার কর্মকর্তাদেরও।[5]তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতিতে পশ্চিমা মিডিয়াতে দেখানো হয় ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি হিসেবে

অন্যদিকে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিজড়া বলতে এমন মানুষকে বোঝায় যাদের জন্মগতভাবে প্রজননব্যবস্থা এবং যৌন বিকাশের ত্রুটি থাকে। এক কথায় সাধারণ মানুষ হিজড়া বলতে বোঝায় ‘যৌন এবং লিঙ্গ প্রতিবন্ধী’ মানুষকে। অর্থাৎ ইন্টারসেক্স বা আন্তঃলিঙ্গ মানুষকে। যেহেতু তাদের সমস্যা জন্মগত এবং এর ওপর তাদের কোন হাত নেই, তাই এ ধরণের মানুষের প্রতি সমাজে সহানুভূতি আছে। এটি হল হিজড়াদের ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সরকারী স্বীকৃতিতেও হিজড়াদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যৌন ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধি হিসেবে। অর্থাৎ যাদের জন্মগত সমস্যা আছে শুধু তাদেরকেই হিজড়া হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।[6]



হিজড়া ও ট্র্যান্সজেন্ডার: শব্দের রাজনীতি

কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ২০১৫ সালে। এ বছর হিজড়াদের সামাজিকীকরণের অংশ হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ে কেরানী বা অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় মোট চৌদ্দ জন হিজড়াকে। দুজন চট্টগ্রামে, বাকিরা ঢাকায়। প্রাথমিকভাবে বাছাই করার পর মেডিকাল টেস্ট করা হয় তাদের। টেস্টে দেখা যায় ঢাকার ১২ জনের মধ্যে ১১ জনেরই লিঙ্গ এবং অন্ডকোষ আছে। তারা সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ। বাকি যে একজন, সেও ছিল জন্মগতভাবে সুস্থ পুরুষ, এই টেস্টের বছর দুই আগে স্বেচ্ছায় সার্জারি করে নিজের লিঙ্গ আর অন্ডকোষ অপসারণ করেছে সে। এরপর বারো জনেরই অ্যাপয়ন্টমেন্ট বাতিল করা হয়।[7]

এ ঘটনার পর থেকে এনজিও এবং এলজিবিটি সংগঠনগুলো তাদের দাবিতে পরিবর্তন আনে।প্রথমত, হিজড়া সনাক্তকরণে শারীরিক পরীক্ষা বাদ দিতে বলে। 
দ্বিতীয়ত, তারা হিজড়ার পাশাপাশি ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটা সামনে আনতে শুরু করে।

শারীরিক পরীক্ষার ব্যাপারে তারা দাবি করে বসে, এতে নাকি যৌন হয়রানী হচ্ছে। অথচ ক্যাডেট কলেজ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী, বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রবাসে কাজ করা মানুষদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষা হয় নিয়মমাফিক, এ নিয়ে কেউ আপত্তি করে না। সমস্যা কেবল হিজড়াতেই ক্ষেত্রেই? 

যেখানে হিজড়াদের বিশেষ সুবিধা এবং স্বীকৃতি দেয়াই হচ্ছে ‘যৌন ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী’ হবার কারণে, সেখানে শারীরিক পরীক্ষা আবশ্যক। কোন মানুষ যদি অন্ধ বা বধির হবার কারণে বিশেষ সুবিধা পায়, ভাতা পায়, তাহলে সে আসলেই অন্ধ বা বধির কি না তা যাচাই করা জরুরী। কাজেই হিজড়াদের শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে এই আপত্তি একেবারেই অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত। 

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। 

এলজিবিটি নেটওয়ার্ক চায় সুস্থ দেহের পুরুষ নিজেকে নারী পরিচয় দিলে, সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে নারী হিসেবে মেনে নেবে। একই ভাবে সুস্থ দেহের নারী নিজেকে পুরুষ বলে পরিচয় দিলেও সমাজ ও রাষ্ট্র সেটা মেনে নেবে। কোন শারীরিক পরীক্ষা থাকবে না, কেউ দাবি করলেই সে স্বীকৃতি পাবে। 

তারা ভেবেছিল হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে এটা অর্জিত হবে। কিন্তু সরকারীভাবে হিজড়াকে যখন যেহেতু 'যৌন ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তাই এতে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। 

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলতে রাষ্ট্র ও সমাজ বোঝাচ্ছে আন্তঃলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স মানুষকে, যাদের জন্মগত সমস্যা আছে। কিন্তু এটাই যদি তৃতীয় লিঙ্গের অর্থ হয় তাহলে নারী সাজা পুরুষ বা পুরুষ সাজা নারীরা (অর্থাৎ 'ট্র্যান্সজেন্ডাররা) এবং স্বেচ্ছায় লিঙ্গ পরিবর্তন করা লোকেরা তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পাবে না। 

যখন শারীরিক পরীক্ষা হবে তখন তারা ধরা পড়ে যাবে। নারী সাজা পুরুষদের মধ্যে আগে যারা হিজড়া বলে পরিচিত ছিল ধরা পড়ে যাবে তারাও। অর্থাৎ ২০১৩ এর স্বীকৃতির ফলে তাদের উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে না, উল্টো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। 

করণীয় কী?

এক্ষেত্রে এলজিবিটি নেটওয়ার্কের সামনে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। হিজড়া শব্দকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা, অথবা 
হিজড়ার পাশাপাশি আইনে ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটা যুক্ত করা। 

হিজড়াকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার মধ্যে বড় ধরনের সমস্যা আছে। পথেঘাটে চাঁদাবাজি, বাসাবাড়িতে হানা দেয়া, দেহব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে হিজড়াদের যুক্ত থাকার খবর প্রায়ই পত্রপত্রিকাতে দেখা যায়। এধরনের কার্যকলাপের কারণে সমাজের অনেক মানুষের মধ্যে হিজড়াদের প্রতি ক্ষোভ আছে। তবু সমাজ তাদের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, কারণ মানুষ মনে করে হিজড়ারা জন্মগতভাবে যৌন ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। এ অবস্থার ওপর তাদের কোন হাত নেই, এবং তাদের প্রতি সমাজের একটা দায়িত্ব আছে। 

কিন্তু কেউ যদি কেউ বলে বসে- হিজড়া আসলে শুধু জন্মগত সমস্যাযুক্ত মানুষ না, বরং শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষও স্বেচ্ছায় হিজড়া হতে পারে। তখন সমাজের ঐ সহানুভূতিটুকু আর থাকে না। কিছু পুরুষ স্বেচ্ছায় নারী সাজছে, সমকামীতায় লিপ্ত হচ্ছে, রাস্তাঘাটে উপদ্রব করছে, নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে আবার তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ সুবিধাও চাইছে - এটা সমাজ মেনে নেবে না। সহানভূতি উবে যাবে, থেকে যাবে ক্ষোভ। ফলাফলটা ভালো হবে না। কাজেই হিজড়া শব্দকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। 

বাংলাদেশে সক্রিয় এলজিবিটি নেটওয়ার্ক এজন্য পরের রাস্তা বেছে নেয়। ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দের ওপর জোর দিতে শুরু করে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে আইনের মধ্যে ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটা ঢুকিয়ে দেয়ার। 

ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দ ব্যবহার করলে দু দিকেই সুবিধা পাওয়া যায়। একদিকে হিজড়া এবং ট্র্যান্সজেন্ডারকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সাধারণ মানুষ যেহেতু হিজড়া বলতে জন্মগত সমস্যাকে বোঝে, তাই এতে করে ‘ট্র্যান্সজেন্ডার’দের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। 

অন্যদিকে ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটাকে আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আইনে ঢুকিয়ে দেয়া গেল এলজিবিটি এজেন্ডার একটা বড় বিজয় চলে আসে। তৈরি হয়ে যায় সমকামীতার বৈধতার পথও। কারণ ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের – পুরুষের নারী সাজা বা নারীর পুরুষ সাজার - অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো সমকামিতাসহ অন্যান্য যৌন বিকৃতি।

এজন্যই ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটাকে আইনে ঢোকানোর জন্য এতোটা জোর দিচ্ছে তারা। এজন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোটা থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের ভোটার আইডি সংশোধনের কাগজপত্রে হিজড়া না লিখে ট্র্যান্সজেন্ডার লেখা হচ্ছে। 

এবং এজন্যই দেখবেন ট্র্যান্সজেন্ডার অ্যাকটিভিস্ট এবং তাদের সমর্থকদের দুটি কাজ করে,

প্রথমত, তারা 'তৃতীয় লিঙ্গ' কথাটার বিরোধিতা করে, কারণ তৃতীয় লিঙ্গ দ্বারা, আন্তলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স মানুষ বোঝানো হয়।https://www.newsbangla24.com/news/168853/Controversy-over-transgender-clinic-at-BSMMU

দ্বিতীয়ত, তারা বলে 'হিজড়া’ কোনো জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিচয় না, এটি একটি সংস্কৃতি।'

এটা বলার মূল কারণ হল আইনের মধ্যে ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটা ঢোকানোর সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য অজুহাত তৈরি করা। যখন তাদের প্রশ্ন করা হবে, হিজড়াদের তো স্বীকৃতি দেয়াই হয়েছে তাহলে তোমরা ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দ নিয়ে কেন এতো মাতামাতি করছো?

তখন তারা বলবে, 'হিজড়া কোন জেন্ডার না, এটা একটি সংস্কৃতি' - আর যেহেতু এটা নির্দিষ্ট একটা সংস্কৃতি তাই অনেকে এই সংস্কৃতি নিজের মধ্যে ধারণা না-ও করতে পারে। হিজড়া নামে নিজেকে পরিচয় না-ও দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দটা ব্যবহার করা উচিৎ।

আদতে মূল কারণ হল, শারীরিকভাবে সুস্থ পুরুষের নারী পরিচয় দিয়ে এবং শারীরিকভাবে সুস্থ নারীর নিজেকে পুরুষ পরিচয় দিয়ে সমকামীতায় লিপ্ত হওয়ার সামাজিক ও আইনী বৈধতা তৈরি।

এই হল হিজড়া আর ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দের পেছনের রাজনীতি।



ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ প্রসারে কার্যক্রম:

গত ৭-৮ বছরে বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে ব্যাপক কার্যক্রম হয়েছে। বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলন বর্তমানে তাদের পুরো শক্তি একত্রিত করেছে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়েছে, মিডিয়াতে ট্র্যান্সজেন্ডারদের তুলে ধরা হচ্ছে ইতিবাচকভাবে, প্রশাসনিকভাবে তাদের একধরণের অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের এই ব্যাপক প্রচারণা ও প্রভাবের পেছনেও আছে সেই পুরনো খেলোয়াড়েরা। পশ্চিমা দাতা, বৈশ্বিক এলজিবিটি নেটওয়ার্ক আর দেশীয় এনজিও। ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ প্রতিষ্ঠায় এসব এনজিও এবং বিভিন্ন এলজিবিটি সংগঠনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে এই ইস্যু নিয়ে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কর্মকান্ড থেকে।

প্রথমদিকে সমকামী পুরুষদের নিয়ে কাজ করলেও গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়েও প্রচুর কাজকর্ম করে যাচ্ছে বন্ধু। নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া বাৎসরিক প্রতিবেদনগুলোতে খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেদের কার্যকলাপের ফিরিস্তি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব প্রতিবেদন যেহেতু ডোনারদের জন্য বানানো তাই কিছুটা অতিরঞ্জন এতে থাকা স্বাভাবিক। তবে সামগ্রিক যে চিত্রটা পাওয়া যায় তা মোটাদাগে সঠিক। এই প্রতিবেদনগুলো থেকে যা বোঝা যায় তা হল, ট্র্যান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তকে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের শিক্ষা, এমনকি মিডিয়াতে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের পক্ষে প্রচারণার, প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে আছে এলজিবিটি সংগঠন, এনজিও এবং তাদের পশ্চিমা মালিকেরা।

মিডিয়া 

অনেকেই লক্ষ্য করেছেন গত ২/৩ বছর ধরে মিডিয়াতে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ এবং পরিচয়কে তুলে ধরা হচ্ছে ইতিবাচকভাবে। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে নিউজ মিডিয়াতে নিয়মিত আসছে নানা ধরনের প্রতিবেদন। বিনোদন জগতের মাধ্যমেও ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতাতেও নারী সাজা পুরুষদের স্থান দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রানারআপও হয়েছে! [8]

বিভিন্ন বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টক শো তে অতিথি হিসেবে আনা হয়েছে নারী সাজা পুরুষদের। সুস্থ দেহের মানুষ অপারেশন করে ‘লিঙ্গ পরিবর্তন’ করছে এমন ঘটনাকে দেখানো হচ্ছে ইতিবাচকভাবে। নারী সাজা পুরুষদের মডেল বানিয়ে আলাদাভাবে নিউজ করা হয়েছে পত্রিকার ফ্যাশন সাময়িকীতে।[9]

এ খবরগুলো দেখতে থাকলে যেকোন মানুষের মনে হতে পারে, হয়তো আমাদের সমাজে দিন দিন ‘ট্র্যান্সজেন্ডার’ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর তাই এতো জায়গাতে দেখা যাচ্ছে তাদের। কিন্তু বিষয়টা আসলে তা না। মিডিয়াতে আসা এই সব ব্যক্তিরা ঘুরেফিরে একই দাতা-এনজিও-অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের অংশ। অল্প কিছু মানুষকে কৌশলে বারবার নানাভাবে মিডিয়াতে আনা হচ্ছে যাতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা যায়।

ব্র্যাক যেমন এলজিবিটির ব্যাপারে ইতিবাচক খবর প্রকাশের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিল ঠিক একই পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে ট্র্যান্সজেন্ডারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ট্র্যান্সজেন্ডার নিয়ে ইতিবাচকভাবে লিখলেই সাংবাদিকরা পাচ্ছে ‘পুরস্কার’। এ কথার স্বীকৃতি এসেছে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নিজস্ব নথিপত্রে। বন্ধু-র ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,


বন্ধু শক্তিশালী মিডিয়া অ্যাডভোকেসি চালিয়ে গেছে যার ফলে ‘নাটক, কমিউনিটি রেডিও , শর্ট ফিল্ম, গণসাক্ষর অভিযান এবং অন্যান্য ভাবে মিডিয়াতে জেন্ডার বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিদের (জিডিপি) শক্তিশালী ইতিবাচক উপস্থাপনা ঘটেছে।’[10]

২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী ৫৬ জন সাংবাদিককে ‘মিডিয়া ফেলোশিপ’ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বন্ধুর কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া এই মিডিয়া ফেলোরা ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পাঁচ বছরে যৌন সংখ্যালঘুদের (অর্থাৎ এলজিবিটি) নিয়ে পত্রপত্রিকাতে মোট ১৪৭টি প্রতিবেদন করেছে।https://web.archive.org/web/20210629053112/https://www.bandhu-bd.org/wp-content/uploads/2017/05/A-Tale-of-Two-Decades.pdf

২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিডিয়ার জন্য বন্ধু-র বারো সদস্যদের উপদেষ্টা কমিটি আছে। এই কমিটি প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া স্ট্র্যাটিজি ঠিক করে। এছাড়া পুরো দেশের বন্ধুর ৯০ জন 'মিডিয়া ফেলো' আছে। যেসব সাংবাদিক 'যৌন বৈচিত্র্যময়' মানুষদের নিয়ে, অর্থাৎ নারী সাজা পুরুষ বা পুরুষ সাজা নারীদের নিয়ে লেখালেখি করতে 'আগ্রহী', বন্ধু তাদেরকে ফেলোশিপ প্রদান করে। বন্ধু বাৎসরিক প্রতিবেদন, ২০২১

এছাড়া একাধিক বেসরকারী টিভি চ্যানেলে (আর টিভি, ডিবিসি ও বাংলা ভিশনে) ট্র্যান্স টক – নামে অনুষ্ঠান স্পন্সর করেছে বন্ধু। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চলছে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের সামাজিকীকরনের কাজ।[11]

বন্ধুর ভাষ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মিডিয়া এলজিবিটি অধিকার সুরক্ষা এবং দাবি আদায়ের ‘দক্ষ ওয়াচডগে’ পরিণত হয়েছে।[12] মিডিয়া যে এলজিবিটি নিয়ে প্রশিক্ষিত কুকুরের মতো আচরণ করছে বন্ধু-র এই দাবির সাথে দ্বিমত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।


সরকার, প্রশাসন

সেই ২০০৭ সাল থেকেই এনজিওগুলো সরকারী নীতিনির্ধারকদের এলজিবিটি এজেন্ডার সমর্থকে পরিণত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয় এবং জাতীয় মানবাধিকার কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘এলজিবিটি এজেন্ডার প্রতি সহনশীল’ করে তুলতে সক্রিয় ও সফল ভূমিকা রেখেছে তারা। এমনকি বন্ধুর দাবি মতে জাতীয় সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলিং পলিসি এবং জাতীয় লিগ্যাল এইড সেবা সংগঠনগুলোকেও ‘যৌন সংখ্যালঘুদে’র (অর্থাৎ এলজিবিটি) ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিতে প্রভাবিত করেছে তারা।[13]

ট্র্যান্সজেন্ডারদের ‘অন্তর্ভুক্তির’ জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে ডিসি, সাংবাদিক, মিডিয়া, উকিল, নাগরিক সংগঠন এবং ট্র্যান্সজেন্ডারদের নিয়ে অ্যাডভোকেসি করেছে বন্ধু। এধরনের অ্যাডভোকেসির ফলস্বরূপ হবিগঞ্জের ডিসি অফিসের পক্ষ থেকে হিজড়া ও ট্র্যান্সজেন্ডারদের জন্যে ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে’ একটি বিলবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে। বন্ধুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিলবোর্ড উদ্বোধনের সময় এনডিসি, অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার এবং এক্সেকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন,বন্ধু বাৎসরিক প্রতিবেদন ২০২২


আমরা সবসময় আপনাদের পাশে আছি। বিলবোর্ড স্থাপনের মাধ্যমে, আমরা আপনার অধিকার নিশ্চিত করতে আপনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং আপনার সাথে একসাথে কাজ করতে একমত পোষণ করছি।"[14]



অন্যান্য:

ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে বন্ধু-র আরও কিছু কর্মকান্ডের তালিকা দেখা যাক-লিগ্যাল হেল্পলাইন তৈরি করেছে।[15]
সমকামী ও অন্যান্য বিকৃতকামীদের ‘মানবাধিকারের’ ব্যাপারে পাঁচশোর বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘সংবেদশনশীল’ করে তুলেছে বন্ধু।[16]
সিলেট হবিগঞ্জ ও মৌলভী বাজারে ইউনিয়ন পর্যায়ে ৯০টি ‘সংলাপ অনুষ্ঠান’ হয়েছে, যেখানে মোট ১৬২০ জন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য অংশগ্রহন করেছে। এসব সংলাপে ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে ‘ট্র্যান্সজেন্ডার এবং হিজড়াদের অন্তর্ভুক্তির’ কথা বলা হয়েছে।[17]
বন্ধুর উদ্যোগে তিন বিভাগে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এই কমিটিগুলোর কাজ হল হিজড়া এবং ট্র্যান্সজেন্ডারদের পক্ষে ওকালতি করা। বিভিন্ন অঙ্গন থেকে ৭৫ জনকে এসব কমিটির মেম্বার বানানো হয়েছে।[18]
এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসমের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতেও কাজ করেছে বন্ধু।
এছাড়া ২৫টি তৃণমূল সংগঠনের ৩৫ জন ব্যক্তিকে অ্যাক্টিভিসমসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বন্ধু।[19]
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ৭৪ জনের বেশি স্টাফকে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের ব্যাপারে সবক দেয়া হয়েছে
ট্র্যান্সজেন্ডারদের চাকরির সুযোগ করে দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘লিংক’ তৈরি করা হয়েছে
ট্র্যান্সজেন্ডারদের মূল ধারার চাকরির বাজারে সুযোগ দেয়ার জন্য চেইম্বার অফ কমার্স, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশের ব্যাংকের কাছে অ্যাডভোকেসি করেছে[20]
ব্র্যাকের অনুকরণে এমপি, অ্যাকাডিমক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রথম আলোর সাথে মিলে গোল টেবিল বৈঠক আয়োজন করেছে, যেখানে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল হিজড়া ট্র্যান্সজেন্ডারদের ‘যৌন অধিকার’ সুরক্ষা, এবং তাদের বিরুদ্ধে ‘বৈষম্য প্রতিরোধ’।[21]
বাংলাদেশ মেডিকাল স্টুডেন্ট সোসাইটি (বিএমএসএস) এর সাথে মিলে তরুণ চিকিৎসকদের মধ্যে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে কাজ করেছে।[22]
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এলজিবিটি মতবাদের ধ্যানধারণার সবক দেয়া হচ্ছে[23]
জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিপোর্টের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থতিত মূল্যায়নের প্রতিবেদনে তৈরিতে অংশ নিয়েছে। ট্র্যান্সজেন্ডারদের নিয়ে আলাদা আইনের কথা বলেছে[24]
ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করে লিঙ্গ পরিবর্তনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের হরমোন থেরাপির ব্যবস্থা করে দিয়েছে[25]
নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার দাবি করা লোকেরা নিজেদের সমকামী যৌনতার কারণে যৌনাঙ্গ ও মলদ্বারের বিভিন্ন যৌন রোগে আক্রান্ত হয়। এদের সহজে চিকিৎসা দেয়ার জন্য অনলাইন এবং অফলাইন পরামর্শের ব্যবস্থা করেছে বন্ধু।[26]

এই রিপোর্টগুলো তাদের সাইটে দেয়া আছে, যে কেউ যাচাই করে নিতে পারেন। এই প্রতিষ্ঠানের ডোনার বা অর্থায়নকারীদের মধ্যে আছে বিদেশী এনজিও, বিভিন্ন দূতাবাস, ইউএসএইড, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা।

No comments:

Post a Comment