Saturday, December 23

কৈশোরে ঘরবন্দী মশিউর এখন সারাবন নামে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে

সারাবন তহুরা পড়াশোনা করছেন রাজধানীর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তাঁর গল্পটা আর দশজনের মতো নয়। তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত নারী)। তাই পরিবার ছেড়ে ঢাকায় থিতু হতে হয়েছে তাঁকে। টিকে থাকতে, জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত লড়তে হচ্ছে। শত কষ্টের মধ্যেও স্বপ্নপূরণে পিছপা হননি সারাবন। এ জন্য পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চান তিনি। ভর্তিও হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা–ও নিজের ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়ে।

প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি হিজড়া সম্প্রদায়ের পরিচিত একজন সারাবনকে দেখিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের নিজের পরিচয়ে ভর্তির সুযোগ দিয়েছিল। এ সুযোগ লুফে নেন সারাবন। চলতি বছর স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হন তিনি।


সারাবন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে নাখালপাড়ার কাউন্সিলর তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করে একটি সনদ দিয়েছিলেন। এর ফলে ভর্তি হতে আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়াশোনার ৭০ শতাংশ খরচ মওকুফ করে দিয়েছে। তবে প্রতি সেমিস্টারের জন্য চার মাস পরপর তাঁকে ১২ হাজার ৮০ টাকা করে জমা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি টাকা দিয়ে তাঁকে সহযোগিতা করছেন।

প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক নুরুন্নবী মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডাররা যাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান, সে চেষ্টা করা হয়েছে। এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ালে তাঁরাও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন।


মশিউর থেকে সারাবনের যাত্রা


সারাবনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়, পরিবারের কাছে। এসএসসি পর্যন্ত তিনি মশিউর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। নিজের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়ে সারাবন বলেন, ‘তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। নিজের ভেতরের পরিবর্তনটা বেশি বুঝতে পারি। যদিও শরীর আগে থেকেই অনেকটা মেয়েলি ধাঁচের ছিল। এ নিয়ে অন্যরা এত বেশি বাজে মন্তব্য করত যে মাঝে মাঝে নিজের নামটা পর্যন্ত ভুলে যেতাম। স্কুলে অবস্থানকালে এবং স্কুলে আসা–যাওয়ার পথে অনেকেই কটূক্তি করতেন, নিপীড়ন করার চেষ্টা করতেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস করছেন সারাবন তহুরাছবি: সংগৃহীত


তবে পরিবর্তনের এই সময়টায় পরিবারের সদস্যদের পাশে পাননি সারাবন। তাঁরা ভাবতেন, ছোট মানুষ বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে সারাবন যখন নিজেকে প্রকাশ করা শুরু করেন, তখন থেকে শুরু হয় নানান ঝামেলা, নির্যাতন। তখন স্কুল ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া তাঁর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

আমাদের মতো মানুষদের টিকে থাকতে তো অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তাই অনেক সময় সুযোগ পেলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারি না।সারাবন তহুরা, ট্রান্সজেন্ডার নারী।


ওই সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সারাবন বলেন, ‘আমি এমন কেন, শুধু এ অপরাধে এক হুজুর একবার খুব মেরেছিলেন। আমি যাতে বাইরে যেতে না পারি, সে জন্য ছেলেদের মতো করে কাবলি সেট বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা–মা দুজনে মিলে ধরে চুল খাবলা খাবলা করে কেটে দিতেন। এসবই ছিল আমি যাতে ঘরবন্দী হয়ে থাকি সেটার বন্দোবস্ত।’


অত্যাচার–নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি ছাড়েন সারাবন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। খুলনা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। এক হিজড়া ‘গুরু মায়ের’ কাছে আশ্রয় নেন। তবে হিজড়া সংস্কৃতি, হিজড়াদের জীবিকা তাঁর শুরু থেকেই তেমন পছন্দের ছিল না। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে তখন এসব করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কিন্তু মন সায় দিত না। এ জন্য একবার হিজড়ার দল থেকে পালিয়ে যান। পরে ধরা পড়ায় সেখানেও নির্যাতন সইতে হয় তাঁকে।

ঢাকায় আসার পর একটি এনজিওতে চাকরি নেন সারাবন। চাকরিসূত্রে তাঁকে যেতে হয় খুলনায়। তবে তখনো বাবা–মা কিংবা পরিবারের অন্যদের আচরণে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আশপাশের মানুষদের সঙ্গেও যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় তাঁকে। ফলে হতাশা চেপে বসে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সারাবন। বেঁচে যান, কিন্তু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় তাঁকে। এত কিছুর পরও পরিবারের সদস্যদের মন গলেনি। সারাবনকে এখনো মেনে নেননি তাঁর বাবা, মা, এক ভাই আর এক বোন।


এখনো লড়ছেন সারাবন


খুলনার পাট চুকিয়ে আবার ঢাকায় ফেরেন সারাবন। তবে এসব করতে গিয়ে তাঁর শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত ঘটে। সারাবন বললেন, ‘এত দিনে মাস্টার্স পাস করে ফেলার কথা ছিল। নিজের সত্তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে পড়াশোনায় বিরতি দিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। তাই পড়াশোনায় অন্যদের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছি।’

সারাবন সমাজে একটু ভালোভাবে থিতু হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন, লড়াই করছেন। তাঁর মানসিক শক্তি খুব প্রবল। তাই আমি সারাবনকে গাইড করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।নাজিবা নাজমি রশিদ অবণি, জাগো ফাউন্ডেশনের ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম অফিসার।


এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও জীবনযুদ্ধের লড়াইটা থামেনি সারাবনের। তিনি জানান, থাকা–খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্য অন্য হিজড়াদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সড়কে–সিগন্যালে মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। তবে এখন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর কিছুটা পরিচিতি হয়েছে। অনেকে চিনতে পারেন। অস্বস্তি এড়াতে মুখের প্রায় বেশির ভাগ অংশ ঢেকে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আয়োজনে শিক্ষক ও অতিথিদের সঙ্গে সারাবন তহুরাছবি: সংগৃহীত


সারাবন বলেন, ‘পথে নামলে অনেকেই চিনে ফেলে। আর মানুষের কাছে হাত পাততেও লজ্জা লাগে। আমি এ কাজটা একেবারে করতে চাই না। কিন্তু আপাতত এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে সপ্তাহে এক দিন কয়েক ঘণ্টা কাজটা করতে হচ্ছে।’

নিজের আসল পরিচয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়ায় প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সারাবন। তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, সহপাঠী—কেউ তাঁর পরিচয় জানার পরও কখনো অবজ্ঞা বা অবহেলা করেননি। যদিও সব সময় ক্লাসে উপস্থিতি থাকতে পারেন না। তবে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।


সারাবনের কণ্ঠে আক্ষেপের সুর। জানালেন, তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো। তারপরও তিনি পরিবারে থেকে নিজের পরিচয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। এখন থাকা–খাওয়ার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় নিজেকেই মেটাতে হচ্ছে। মাঝে প্রায় পাঁচ মাস কোনো বাসা ভাড়া নিতে পারছিলেন না। একটি বস্তিতে থেকেছেন। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেও পড়াশোনাটা চালিয়ে নেওয়া মাঝেমধ্যেই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

সারাবন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ভর্তি হতে পারলেই তো হবে না, আমাদের অন্যান্য খরচও নিজেদেরই বহন করতে হয়। আমার বিভাগের অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে গেলেও খরচের কথা চিন্তা করে আমি যেতে পারি না। আমার সঙ্গে আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, তবে খরচ কুলাতে না পেরে ঝরে পড়েছেন।’


সারাবন আরও বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষদের টিকে থাকতে তো অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তাই অনেক সময় সুযোগ পেলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারি না।’

দক্ষতা বাড়াচ্ছেন সারাবন


হিজড়াদের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলেও তাঁদের কাজ কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি সারাবন। তাই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর মনে সব সময় ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। গ্রাফিক ডিজাইনে একটি কোম্পানিতে ইন্টার্ন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন সারাবন তহুরা


সারাবন জানান, গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ টুকটাক শিখেছিলেন। পরে ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে দেখে হাত পোক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে তিনি একটি কোম্পানিতে কাজ শেখেন। পরে সেখানে কাজে যুক্ত হন। এ কাজ পাওয়া ও সার্বিক সহায়তার জন্য জাগো ফাউন্ডেশনের ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম অফিসার নাজিবা নাজমি রশিদ অবণির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সারাবন। জানালেন, শুধু এ কাজ পাওয়া নয়, বিভিন্ন সময়ই অবণি তাঁকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর পাশে ছিলেন।

নাজিবা নাজমি রশিদ অবণির সঙ্গেও কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিকভাবে নয়, তবে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সারাবনের পাশে থাকার চেষ্টা করি আমি। এখন যে কোম্পানিতে সারাবন ইন্টার্ন করছেন, সেটার খোঁজ আমিই দিয়েছিলাম। তবে সারাবনের জীবনবৃত্তান্ত দেখে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরই চাকরি হয়েছে। সারাবন সমাজে একটু ভালোভাবে থিতু হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন, লড়াই করছেন। তাঁর মানসিক শক্তি খুব প্রবল। তাই আমি সারাবনকে গাইড করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

https://www.prothomalo.com/bangladesh/gr5m0481va?fbclid=IwAR3IXzFcvgMRwPQvKE6ddPNGtJYDYbnlWTOuiuMfyc4ozyAUUk1U-i9QOqU

No comments:

Post a Comment