Tuesday, July 25

আপিল বিভাগের তোপের মুখে আসামির আইনজীবী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (রাবি) অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যাকাণ্ড ৭১-এর বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আসামির আইনজীবীর উদ্দেশে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আরেক শিক্ষকের পূর্ব পরিকল্পনায় তার বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর তাকে হত্যা করেছেন। ওই কেয়ারটেকার ড. তাহেরের পয়সায় লালিত-পালিত হয়েছেন। যার পয়সায় লালিত-পালিত হয়েছেন তাকেই উনি হত্যা করেছেন। মামলার বিচারের সময় এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে আমাদের। মঙ্গলবার আসামি জাহাঙ্গীরের ফাঁসি স্থগিত চেয়ে করা এক আবেদনের শুনানিকালে আইনজীবী এস.এন গোস্বামীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি এ মন্তব্য করেন।

হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে আবেদন করায় আপিল বিভাগের তোপের মুখে পড়েন ওই আইনজীবী। বিচারপতিদের একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত ওই আইনজীবী কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।


ওই আইনজীবীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই মামলায় আসামিদের আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তির পর ফাঁসি বহাল রাখা হয়েছে। যে আইনি প্রশ্নের জবাব চাইতে এসেছেন সেটা তো আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ওই পর্যবেক্ষণ মানা তো আপনার জন্য বাধ্যতামূলক। সেই পর্যবেক্ষণ না দেখেই আপনি রিট করে কেন এই মামলাকে রি-ওপেন করার চেষ্টা করছেন। আমরা যদি ওই আইনি প্রশ্নের জবাব রায়ের পর্যবেক্ষণে না দিতাম তাহলে আপনার কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ ছিল।

ড. তাহের হত্যা মামলার দুই আসামি রাবির শিক্ষক মিয়া মো. মহিউদ্দিন ও কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি বহাল রেখে তাদের আপিল ও রিভিউ খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পরে আসামিদের প্রাণ ভিক্ষার আবেদনও খারিজ করে দিয়েছেন। প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজের পর আসামিদের ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে দুই দফায় হাইকোর্টে রিট করেন খুনির স্বজনরা। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরের ভাই সোরহাবের করা একটি রিটও খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে যায় আসামি পক্ষ। তখন বিষয়টি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দিয়ে চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, নিষ্পত্তিকৃত আইনি প্রশ্নে কেন বার বার আদালতে আসছেন। আপিল বিভাগের রায়ে তো এই আইনি প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে।


প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে জাহাঙ্গীরের ফাঁসি স্থগিত চেয়ে তার ভাইয়ের করা আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে আসামি পক্ষের কৌসুলি অ্যাডভোকেট এসএন গোস্বামী বলেন, জাহাঙ্গীরকে আটকের ২৪ ঘণ্টা পর আদালতে তোলা হয়েছে। এটা সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি রায়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে তো এর সমাধান দেয়া হয়েছে। এরপরেও কেন রিট করলেন? যেখানে আপিল ও রিভিউর নিষ্পত্তি হয়েছে সেখানে এ পর্যায়ে এসে এই বিষয়টিকে রিটে গ্রহণ করার সুযোগ আছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের একটি নজির দেখান যেখানে চূড়ান্ত আইনি প্রক্রিয়া নিষ্পত্তির পর এ ধরনের রিট বিবেচনায় নেওয়া সুযোগ আছে।

ওই আইনজীবীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রেফতারের আগে তাকে থানায় ডেকে নেয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। পরে খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় পুলিশ গ্রেফতার করে এবং যথাসময়ে আদালতে হাজির করে। কিন্তু আপনি (আইনজীবী) বলছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে তোলা হয়নি। এই আবেদন দেখে মনে হয় আইনি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অথরিটি (কর্তৃত্ব) আপনি। সেই সুযোগ কি আছে আপনার? তখন আইনজীবী বলেন, সেই সুযোগ কখনোই আমার নাই। প্রধান বিচারপতি বলেন, যদি সুযোগ না থাকে তাহলে এ ধরনের আবেদন নিয়ে কেন এনেছেন।

তখন আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বেঞ্চের অপর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে এই আইনি প্রশ্নের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আর ক্লায়েন্টকে (মক্কেল) সঠিক পরামর্শ দেওয়াও আইনজীবীর দায়িত্ব। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম বলেন, আপনি (আইনজীবী) যে বিষয়ে রিট করেছেন তার উত্তর তো রায়েই দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম বলেন, নিষ্পত্তিকৃত বিষয়ে রিট করায় এই আইনজীবীকে জরিমানা করা উচিত।

এ পর্যায়ে ওই আইনজীবীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আপনার দু’টি চোখের একটি অন্ধ। আপনি শুধু এক পক্ষের কথাই চিন্তা করেন। অপর পক্ষেরটা আপনার বিবেচনায় নেই। আমি এর আগেও বলেছি, যখন আমরা মামলার বিচার করতে বসি তখন আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের পাশাপাশি ভিকটিমের দুর্দশার বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়ে থাকি। আপনি এ ধরনের আবেদন করে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. মোরশেদ বলেন, আসামি পক্ষ রিট করে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের অনেক ধৈর্য ধরে মামলা শুনতে হয়। না শুনে আমরা কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এরপরই প্রধান বিচারপতি আসামির আবেদনটি খারিজ করে দেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ। এই মামলার চার্জশিটে বলা হয়, ড. তাহের জীবিত থাকলে কখনোই পদোন্নতি পাবেন না-এমন ধারণা থেকেই ষড়যন্ত্র ও খুনিদের প্রলোভন দিয়ে তাকে খুন করান মিয়া মো. মহিউদ্দিন। এরপর তার পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক খুনিরা ড. তাহেরকে হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেন। ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল চারজনকে ফাঁসির আদেশ দেন। হাইকোর্ট ২০১৩ সালে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি বহাল রাখেন। সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয় নাজমুল ও সালামকে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।

রায়ে বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ড ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড ছিল নজিরবিহীন মহা অপরাধ।

এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে তিন আসামির করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। রিভিউ খারিজের আদেশ কারাগারে পৌছলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান আসামিরা। সেই প্রাণভিক্ষার আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। নাকচের সেই চিঠি গত ৬ জুলাই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। জেল কোড অনুযায়ী চিঠি হাতে পাওয়ার ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে যেকোনো ফাঁসি কার্যকরের নিয়ম রয়েছে।

এই চিঠি পৌছার পরই ফাঁসি স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন খুনি জাহাঙ্গীরের ভাই। এতে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি থেমে যায়। তবে কোনো সারবত্ত্বা না থাকায় রিটটি গতকাল সোমবার সরাসরি খারিজ করে দেন বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদালত বলেন, ফাঁসি বহাল রেখে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন সেখানে আমাদের হাত দেওয়ার কোন সুযোগ নাই।

এর আগে গত মে মাসে খুনি মহিউদ্দিনের স্ত্রী ও জাহাঙ্গীরের ভাই ফাঁসি ঠেকাতে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করেন। ওই রিট খারিজ করে বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. বশিরউল্লাহর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, এ ধরনের ফৌজদারি মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক আপিল ও রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির পর রিট আবেদন করার কোন সুযোগ নেই।

https://www.ittefaq.com.bd/653202/%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A7%80?fbclid=IwAR0XZANzm1NGC_hB_pNLFALRdf2zzmugm5oJXZ3obPDHdTaksgjdXJ4nZGk

No comments:

Post a Comment