Sunday, July 2

সঞ্জীবনীর সংগ্রাম

সঞ্জীবনী সুধা, প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত পূরণ করে এমফিল করতে যাচ্ছেন। তাঁর এমফিল প্রস্তাবনার বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ’। সংগ্রামী জীবনের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমতার সঙ্গে। লিখেছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায়। শৈশব ও কৈশোর সেখানেই কেটেছে। দুই বোনের ছোট্ট সংসার। বাবা কখনও চাকরি করতেন, কখনও ব্যবসা করতেন। মা এক সময় ব্যবসা করতেন। তবে এখন গৃহিণী। শৈশব থেকেই তাঁর জীবন সংগ্রামে বেড়ে ওঠা। স্কুল-কলেজ, পাড়া-প্রতিবেশী তাঁকে ভিন্ন চোখে দেখত। স্কুলে ছেলে বা মেয়ে কোনো বেঞ্চে বসতে দিত না। আলাদা বেঞ্চে একাকী বসতে হতো। ‘জন্মই যেন তাঁর আজন্ম পাপ’– এমনটি ভাবতেন। কিন্তু সবার এই আড়চোখ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। মেধা, মনন আর শ্রম দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন নিজেই। সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে যেতাম অনেক বন্ধুরা আমার শরীরের ওপর প্রস্রাব ঢেলে দিত। আমাকে নিয়ে মজা নিত। কেন আমি স্কুলে যাই। কেন আমি বাড়িতে থাকি না। আমার মতো কেউ এলাকায় ছিল না। তাই প্রতিনিয়ত আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে।’


নিজ উপজেলা থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে ভর্তি পরীক্ষা দেন রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সুযোগ পান মেধার ভিত্তিতে। রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তাঁকে ছেলেদের হলে সিট পড়ে। চুল ছোট রাখতে হবে। এমন অসংখ্য শর্ত দেওয়া হয়। সবকিছু জয় করে সেখান থেকেই অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। থেমে থাকেনি তাঁর পড়াশোনা। যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে আবেদন করেন। সব শর্ত পূরণ করে তিনি এমফিল শুরু করতে যাচ্ছেন।

পারিবারিক সাপোর্ট


সঞ্জীবনী সুধার এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে সমাজের মানুষের সহযোগিতা পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। তাঁর মতো সন্তানকে সমর্থন দেওয়াটা সমাজের চক্ষুশূল ছিল। এ সম্পর্কে সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমার জন্য পরিবারকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। মা-বাবাকে সমাজে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হতে হয়েছে। এখনও একই রকম আছে। কারণ আমার মা-বাবা সেই সমাজেই বসবাস করেন, যা লাজুকতায় ভরা। আমার অবস্থার হয়তো পরিবর্তন হয়েছে। সুশীলদের সঙ্গে ওঠাবসা বা অন্য সমাজে বসবাস করি। গ্রামে এখনও আমাদের মতো সন্তানদের জন্য পরিবারকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়। কয়েক বছর আগেও আমাদের একঘরে রাখা হতো। অন্য পরিবারের সঙ্গে মিশতে দিত না। মা-বাবাকে এখনও হেয়প্রতিপন্নতার শিকার হতে হয়। এটি আসলে এক বর্বর সমাজের প্রতিচ্ছবি। খারাপ লাগে, আমার মতো সন্তান জন্মগ্রহণ করার মতো পরিবারকে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়। ভবিষ্যতেও হয়তো সমাজে কথা শুনতেই হবে। সব চাপ নীরবে সয়ে যেতে হবে। তবে এতকিছুর পরও মা-বাবা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন; যা আমার জীবনে ছিল সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট।’

এমফিলের বিষয়বস্তু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধীনে অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীনের তত্ত্বাবধানে এমফিল করতে যাচ্ছেন সঞ্জীবনী। তাঁর এমফিলের প্রস্তাবনার বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ’। যুক্ত হবেন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এমফিল প্রোগ্রামে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জেন্ডারভিত্তিক কাজই আমার এমফিলের বিষয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে কীভাবে রিফ্রেম হচ্ছে বা কীভাবে রিফ্রেম হয়।’

সমাজে চলতে

প্রতিনিয়ত সঞ্জীবনীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শুধু আমি না, আমার মতো যারা আছেন তাঁদের সবাইকে একইভাবে সংগ্রাম করে চলতে হয়। এই সমাজে আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে একটি পেশার সঙ্গে জড়িত। একজন ব্যাংকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, মানবাধিকারকর্মী। যখন আমি রিকশায় অফিসে যাই বা অন্য কোনো সামাজিক কাজে যুক্ত হই, তখন আমাকে কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। আমাকে বাধার কবলে পড়তে হয়। কখনও কখনও সেগুলো সহনশীল মাত্রায় থাকে, কখনও আবার মাত্রা ছেড়ে যায়। সেটি ভিন্ন কথা। আমাকে চলতে-ফিরতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই চলতে হয়। আমার বেঁচে থাকার জন্য, মানুষ হিসেবে টিকে থাকার জন্য বা আমার জীবিকা নির্বাহের জন্য এই সমাজে সংগ্রাম করেই এগোতে হয়। মোট কথা, মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য আমাকে সংগ্রাম করতেই হয়।’

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত। চোখের সামনে মা-বাবাকে অপমান বা হেয় করার চেয়ে বড় পীড়াদায়ক আর কী হতে পারে! সঞ্জীবনী বলেন, বাজারে সন্তানের জন্য মা-বাবাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হতে হয়েছে, এর চেয়ে লজ্জাজনক কিছু হতে পারে না। আমি যতদিন বেঁচে থাকব এ বিষয়টি হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। এখন সেই সমাজের মানুষগুলো যখন বলে, আপনার সন্তান এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আপনি গর্বিত মা। তখন আমার ভেতরের কষ্টগুলো জেগে ওঠে।

নিজেই নিজের প্রেরণা

সঞ্জীবনী জানান, ছোটবেলা থেকেই তাঁর শারীরিক অনেক সমস্যা ছিল। তখন থেকে নিজেকে নারী মনে করতেন। কখনও পুরুষ মনে করতেন না। তাঁর মনে করাকে কেউ পাত্তাও দিত না। তিনি কাউকে অনুপ্রেরণা মনে করেননি। নিজের মতোই হতে চেয়েছেন তিনি। সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমার প্রেরণা আমি নিজেই। চিন্তা, মেধা আর মননে তৈরি করেছি নিজেকে। আমি আমার মাকে দেখতাম। তাঁকে আমি আইডল মনে করি। তাঁর চলাফেরা, কথা-বার্তা আমাকে বিমোহিত করত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতো মানুষের মানসিক সমস্যাটিই বড়। আমি এটিকে পরিপূর্ণ সাপোর্ট দিতে পারব। আমার পড়াশোনা, আমার সব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানসিক সাপোর্ট দেব।’

দেশে ২০২০ সালের মার্চে যখন করোনা মহামারি হানা দেয়, তখন আপনজনকে ফেলে রেখে চলে যান অনেকে। সে সময় এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন সঞ্জীবনী। বীভৎস সেই সময়ে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকারের কাজে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। তখন তিনবার করোনায় আক্রান্ত হন। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সঞ্জীবনী বলেন, ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমি এক সময় চাকরি করতাম। করোনা মহামারিতে অনেক স্বজন লাশ রেখে পালিয়ে যেতেন। এই করুণ দৃশ্য আমাকে ব্যথিত করে। পরে কর্তৃপক্ষকে আমি করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকার করাতে রাজি করাই। চট্টগ্রামে আড়াই মাস এই কাজ করি। ঢাকায় এসে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে প্রায় এক বছরে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষের লাশ দাফন বা সৎকারের কাজ করেছি। তখন একটি পত্রিকা আমাকে নিয়ে নিউজ করে। সেটি দেখে আমার অনেক বন্ধু ফোন দিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চান– যাঁরা এর আগে আমাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। এটি আমার কাছে একটি স্মরণীয় ঘটনা।’

নিজের মানুষ পরিচয়ের জন্যই সঞ্জীবনীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ও হচ্ছে। তাই মানবিকতাই রয়েছে তাঁর চিন্তার মূলে। সঞ্জীবনী বলেন, ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখুন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করুন, ভালোবাসুন। বিপদে পাশে দাঁড়ান। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন– ওই মানুষটির জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন। তাহলে নিজেই উত্তর পেয়ে যাবেন।’ সমাজে কে কী বলল, তা পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে পথচলাকে আদর্শ করে নিয়েছেন সঞ্জীবনী।

https://samakal.com/crime/article/181042/%E0%A6%B8%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE

No comments:

Post a Comment