সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নিজের নাম নিবন্ধন করতে গিয়ে বেশ খানিকটা দ্বিধায় ছিলেন ইয়াছিন আহমেদ সকাল। একে তো ট্রান্সজেন্ডার, অন্যদিকে নামটাও পাল্টানো হয়নি এখনো, হয়তো নিবন্ধনপ্রক্রিয়া থেকেই বাদ পড়বেন। তবে শেষ পর্যন্ত নিবন্ধনেই থেমে থাকেননি, ‘মিস এভারগ্রিন বাংলাদেশ’ সিজন ওয়ানে দ্বিতীয় রানার্সআপের পুরস্কার জিতে নিয়েছেন রূপান্তরিত নারী ইয়াছিন। ১১ নভেম্বর রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ঝলমলে অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট ও অন্যান্য উপহারের পাশাপাশি পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকার চেক।
বাংলাদেশের কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ইয়াছিন আহমেদ সকাল। এর আগে আরেকটি প্রতিযোগিতা ‘মিস্টার অ্যান্ড মিস ফ্রেশ লুক সিজন চার’-এ দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছিলেন।
ইয়াছিন আহমেদ সকাল বললেন, ‘যাঁরা নারী হিসেবেই জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়েছি—এটা আমার জন্য অনেক পাওয়া। আর মানুষের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, এটাও তার প্রমাণ। লিঙ্গবৈচিত্র্যময় মানুষেরও জয় হয়েছে এতে।’
‘মিস এভারগ্রিন বাংলাদেশ’ সিজন ওয়ানের আয়োজন করেছিল ম্যাকয় নামের একটি পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান। ম্যাকয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফ্যাশন ডিজাইনার মেসবাহ্ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করা প্রতিযোগীদের মধ্যে ইয়াছিন আহমেদ সকাল ও আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার রাদিয়া তেহরিন উৎস প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এই দুজন যেমন দ্বিধার মধ্যে ছিলেন, আমরাও খানিকটা দ্বিধার মধ্যে ছিলাম। পরে ভাবলাম, অনেকেই তো তাঁদের পিছিয়ে রাখতে চায়, আমরা সাহস করে তাঁদের নিয়ে নিই।’
পুরুষের শরীর নিয়ে জন্ম নিলেও ইয়াছিন ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারতেন তাঁর মনের ভেতরে একজন নারীর বসবাস। তবে পরিবারের বড় সন্তান ও লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য ট্রান্সজেন্ডারদের মতো এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়নি। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করেন।
মেসবাহ্ উল আলম বলেন, একজন শেষ পর্যন্ত মুকুট না পেলেও ইয়াছিন আহমেদ সকাল নিজ যোগ্যতায় বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ট্রান্সজেন্ডার বলে তাঁর প্রতি বিচারকেরা সহানুভূতিশীল ছিলেন, বিষয়টি তেমন নয়। প্রতিযোগীদের পক্ষে যে অভিভাবকেরা ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে একজন এবং গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধিও বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেন। শুরুর দিকে প্রতিযোগিতার কিছু বিষয়ে ঝামেলা হলেও বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি।
মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা বলেন ইয়াছিন আহমেদ সকাল। জানালেন, নাম পরিবর্তনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
আবৃত্তিতে জাতীয় পুরস্কার, অভিনয় করছেন চলচ্চিত্রেও
নরসিংদীর শিবপুরে বড় হওয়া ইয়াছিন বর্তমানে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজিতে অনার্স করছেন। রেডিওতে জকি হিসেবে কাজ করেছেন। মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আবৃত্তিতে পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। বর্তমানে সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘বকুল কথা’ চলচ্চিত্রে ট্রান্সজেন্ডার চরিত্রেও অভিনয় করছেন ইয়াছিন। এ ছাড়া সাভারে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডাররা কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, এমন প্রতিষ্ঠান এল আর ফ্যাশন গার্মেন্টসে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবেও প্রায় দেড় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
‘প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করা প্রতিযোগীদের মধ্যে ইয়াছিন আহমেদ সকাল এবং আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার রাদিয়া তেহরিন উৎস প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এই দুজন যেমন দ্বিধার মধ্যে ছিলেন, আমরাও খানিকটা দ্বিধার মধ্যে ছিলাম। পরে ভাবলাম, অনেকেই তো তাঁদের পিছিয়ে রাখতে চায়, আমরা সাহস করে তাঁদের নিয়ে নিই।’মেসবাহ্ উল আলম, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং মিস এভারগ্রিন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার আয়োজক
ইয়াছিন জানান, সুন্দরী প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালেতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন চিত্রনায়িকা রোজিনা, মাহিয়া মাহি, সংগীতশিল্পী আঁখি আলমগীর, নৃত্য পরিচালক ইভান শাহরিয়ার, রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভিন ও মডেল অন্তু করিম। তাঁদের টানা দেড় মাস গ্রুমিং করিয়ে দক্ষ করে তোলেন কোরিওগ্রাফার বুলবুল টুম্পা।
ইয়াছিন আহমেদ সকাল জানান, পারিবারিক সমস্যায় তাঁর বাবা ও মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাঁরা দুজনই আবার বিয়ে করেছেন। বর্তমানে ইয়াছিনের ছোট দুই বোন ঢাকায় তাঁর কাছে থেকেই পড়াশোনা করছেন।
আরও পড়ুন
পুরুষের শরীর নিয়ে জন্ম নিলেও ইয়াছিন ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারতেন, তাঁর মনের ভেতর একজন নারীর বসবাস। তবে পরিবারের বড় সন্তান ও লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য ট্রান্সজেন্ডারদের মতো এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়নি। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করেন।
ইয়াছিন আহমেদ সকালছবি: মানসুরা হোসাইন
মা ও বাবা ইয়াছিনের কোনো কাজে বাধা দেননি, আবার তাঁর এ পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বিষয়টি, তেমনও নয়। তাই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর ঘটা করে বিষয়টি বাবা বা মাকে জানাননি তিনি। করোনার সময় আর্থিক সমস্যায় পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। তখন ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করা জি প্রজেক্টের মাধ্যমে অটো ইন্টারন্যাশনাল পড়াশোনার খরচ দেয়।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে ইয়াছিন বলেন, ‘শুরুতে মনে দ্বিধা থাকলেও যখন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য ডাক পাই, তখন আত্মবিশ্বাস খানিকটা বাড়ে। এখানে কোনো স্বজনপ্রীতির সুযোগ ছিল না। ট্রান্সজেন্ডার বলে বাড়তি কোনো সুবিধাও পাইনি। নিজের যোগ্যতায় বিজয়ী হয়েছি। তবে অন্য প্রতিযোগীরা সহযোগিতা করেছেন বলে সময়টুকু ভালো কেটেছে। বিজয়ী হওয়ার পর মনে হয়েছে, আমার মতো হাজারো সকাল নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য সামনে এগিয়ে আসার সাহস পাবেন।’
আরও পড়ুন
হতে চান ফ্যাশন ডিজাইনার
ইয়াছিনের মতে, সুন্দরী প্রতিযোগিতা মানেই নায়িকা তৈরি করা—এ ধারণা পাল্টেছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে নানা বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন, এমন প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা হয়। প্রতিযোগীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে ভেতরের যে সৌন্দর্য, তা–ই প্রতিযোগিতায় গুরুত্ব পাচ্ছে।
পুরুষ থেকে একজন নারীর পরিচয়ে পরিচিত হতে গিয়ে একেবারেই কি কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়নি, এ প্রশ্নে ইয়াছিন বলেন, ভালো ব্যবহার দিয়ে তিনি অন্যের কাছ থেকেও ভালো ব্যবহার আদায় করে নেন। তবে অনেকে পেছনে কটু কথা বলেন, তা–ও তিনি জানেন। গণমাধ্যমে কোনো খবর বা ছবি প্রকাশিত হলে পাঠকেরা বাজে মন্তব্য করেন।
তবে ইয়াছিন মনে করেন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সময় লাগবে। সমাজ তো আর এক দিনে পরিবর্তন হবে না।
১১ নভেম্বর রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট ও অন্যান্য উপহারের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকার চেক পেয়েছেন ইয়াছিনছবি: সংগৃহীত
ইয়াছিনের মতে, যে মানুষেরা হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে জানেন না, তাঁরাই বাজে মন্তব্য করেন। যখন তাঁরা বুঝতে পারবেন, তখন আর বাজে মন্তব্য করবেন না।
ইয়াছিন ভবিষ্যতে একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চান। মডেলিং করে অন্যদের কাছে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে চান।
No comments:
Post a Comment