হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের চাঁদবাজিতে ক্ষুব্ধ ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। পথেঘাটে, ট্রাফিক সিগন্যালে, বিয়ের অনুষ্ঠানে বা বর-কনে বহন করা গাড়িতে এমনকি বাসাবাড়িতে গিয়েও জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করছে হিজড়ার দল। এঁদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারস্থ হলেও কোনো সুরাহা পায় না জনসাধারণ। চাঁদাবাজির লাভের লোভে দিব্যি পুরুষ বা নারী হঠাৎ এলাকায় ফেরেন হিজড়ার বেশে।
এরপর তাঁরা স্থায়ী হয়ে যান হিজড়াদের সদস্য হিসেবে। হিজড়াদের মধ্যে নেতৃত্বে থাকেন তাঁদের সর্দারনি, যাকে তাঁরা গুরুমা বলে থাকেন। মূলত তাঁর কথায়ই চলতে হয় অন্য সদস্যদের। এই গুরুমায়েরা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য নির্ধারিত।
সেসব এলাকা আবার বেচাকেনাও হয় লাখ লাখ টাকায়। সম্প্রতি এমনই কিছু ঘটনা বের হয়ে এসেছে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে।
সাধারণ মানুষ হিজড়াদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও আসল হিজড়াদের জীবনে রয়েছে অনেক বঞ্চনার কাহিনি। কেউ জন্মগতভাবে হিজড়া হলে তাকে ছাড়তে হচ্ছে পরিবার ও সমাজ।
কোথাও স্থান না পেয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় বাধ্য হয়ে তাদের যোগ দিতে হচ্ছে হিজড়াসমাজে। সেখানে গুরুমার নির্দেশে নামতে হচ্ছে চাঁদা আদায়ে। তবে অনেকে আবার লোভের বশবর্তী হয়ে সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের নান্দাইলের বেশ কয়েকটি পরিবারে। এদের মধ্যে পৌরসভার ভাটিকান্দাপাড়ার মো. মুর্শিদের ছেলে সুমন মিয়া (২৮)।
প্রায় ১০ বছর আগে হঠাৎ তিনি হিজড়া হয়ে এলাকায় আসেন। এখন তাঁর নাম সুমন হিজড়া। অন্যদিকে উপজেলার চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের খামারগাঁও গ্রামের চুন্নু মিয়ার ছেলে রাজন মিয়া (২০) ইটভাটায় কাজ করতেন। হঠাৎ তিনিও হিজড়া সেজে অন্য হিজড়াদের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ির বনগাঁও গ্রামের আছর আলীর ছেলে রোমান মিয়া ছিলেন ভ্যানচালক। হঠাৎ তিনি হিজড়া সেজে নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন রুবি হিজড়া।
তিনি জানান, এই পথে আয় বেশি। তাই এক গুরুমাকে কয়েক লাখ (অঙ্কটা বলতে চাননি) টাকা দিয়ে একটা দলের সদস্য হয়েছেন। এখন ইচ্ছা থাকলেও এই পথ থেকে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি।
সুমন হিজড়ার অভিযোগ, এখন আর আগের মতো আয় হয় না। রাত পোহালেই নতুন নতুন হিজড়ার আবির্ভাব হয়। তিনি জানান, তাঁর নিজের কিছু অর্থ ছিল। তা ছাড়া চাপ দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করে এবং ধারদেনা করে ২০০৭ সালে ছয়টি উপজেলার দায়িত্ব কিনেছেন একজন গুরুমার কাছ থেকে। এতে তাঁর খরচ হয় পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু এত দিনেও তাঁর ওই টাকা ওঠাতে পারেননি। বর্তমানে পাওনাদারদের তাগাদায় তিনি বেশ বেকায়দায় রয়েছেন।
কিভাবে ছয়টি উপজেলা কিনলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর গ্রামের জহুরা হিজড়া ওরফে পান্নু হিজড়া নামে এক গুরুমা ছিল। তার কাছ থেকে ২০০৭ সালের ১০ এপ্রিল দলিল করে তাড়াইল, করিমগঞ্জ, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, নান্দাইল এবং ঈশ্বরগঞ্জ—এই ছয় উপজেলার দায়িত্ব কিনেছিলাম। কিন্তু এক বছর আমার কথায় সব চললেও এখন আর কেউ মানছে না। আরো অনেক হিজড়া ও সর্দারনির আবির্ভাব হয়েছে।’ সুমন হিজড়া এ সময় কালের কণ্ঠ প্রতিবেদককে এলাকা ক্রয়ের একটি এফিডেভিট কপিও দেখান।
জানা যায়, সুমন হিজড়ার দলে যাঁরা রয়েছেন, কেউ আসল হিজড়া নয়। প্রায় ১২ জনের দলে সবাই পুরুষ। কেউ হিজড়া সেজে আবার কেউ বা সার্জারি করে হিজড়া বেশ ধারণ করেছেন।
হিজড়াদের চাঁদাবাজির শিকার হাফেজ আজিজুর রহমান জানান, তিনি গত চার দিন আগে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক দিয়ে কেন্দুয়ার মোজাফফরপুর গ্রামে যাচ্ছিলেন একটি মাইক্রোবাসযোগে। পথে নান্দাইল সদরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছামাত্রই রাত ৯টার দিকে পথরোধ করে একদল হিজড়া। এ সময় তারা এক হাজার টাকা দাবি করে। না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে গাড়ির মধ্যে আঘাত করে চলে যায়। এতে গাড়ির ক্ষতি হওয়ায় গাড়ির মালিক আট হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়েছে তাঁর কাছ থেকে।
নান্দাইল থানার ওসি রাশেদুজ্জামান জানান, তিনি মাঝেমধ্যে হিজড়াদের অত্যাচারের বিষয়টি অবগত হয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠান। কিন্তু এতে কয়েক দিন নিবৃত্ত থাকলেও ফের এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
No comments:
Post a Comment