Wednesday, January 25

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৩: তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার স্বরূপ

আজ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসেবে উদযাপন হচ্ছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর (এসডিজি) ৪ নম্বর লক্ষ্য ‘সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি’র বিষয়টি সামনে রেখে এ দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। প্রাসঙ্গিকভাবে সমাজের একেবারে অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ অর্থাৎ হিজড়াদের শিক্ষা-সাক্ষরতার বিষয়টি আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে এ দিবসে।


বাংলাদেশে হিজড়াদের শিক্ষাচিত্র
দেশে হিজড়াদের মধ্যে শিক্ষার হার একেবারে নগণ্য। ফলে তারা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সমাজে একধরনের বোঝা হয়ে অবস্থান করছে। শিক্ষা-সাক্ষরতার ঘাটতিও হিজড়াদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথে অন্যতম অন্তরায়, যা তাদের অধিকার সচেতন হওয়া ও জীবনবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে রাখছে। দেশে অন্য প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও হিজড়াদের জন্য তেমন ব্যবস্থা নেই। মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও হিজড়াদের পড়ালেখার কোনো ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি এ দেশে। আমাদের সমাজে সাধারণত একটি শিশু জন্মের পর তার লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে অভিভাবকরা মেয়ে বা ছেলে হিসেবে স্কুলে ভর্তি করিয়ে থাকেন। কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারের কারণে হিজড়াদের শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও ২০২১ বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জানায়, প্রথমবারের মতো এখন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সময় প্রত্যেকে তার নিজের পরিচয় ব্যবহার করে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু সেটি এখনও কথার কথা মাত্র।


মূলত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ দেশে হিজড়াদের পরিচয় সংকট ঘুচলেও তাদের শিক্ষার সংকট এখনও প্রকট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালে এ হার ছিল ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ হিসাবে ১১ বছরে হিজড়াদের সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র এক দশমিক ৬৩ শতাংশ। অথচ এ সময়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার বেড়েছে ২২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।


সংখ্যা নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁকি
হিজড়াদের শিক্ষার আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই তাদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করতে হবে। বাস্তবতা হলো সমাজসেবা অধিদফতরের হাতে হিজড়াদের সঠিক পরিসংখ্যানই নেই। জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশে হিজড়ার মোট সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার ৬২৯ জন। ২০১৯ সালে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে প্রকাশিত এক জার্নালে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের দাবি, বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ লাখ! [দেশ রূপান্তর (অলনাইন ভার্সন), ১ জানুয়ারি, ২০২১]।


আর হিজড়াদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ জানায়, বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে দেশে হিজড়ার সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে [বিবিসি বাংলা, ১২ নভেম্বর ২০২০]। এ সংখ্যা সরকারি হিসাবের ২৫ গুণের বেশি। হিজড়াদের এ সংখ্যা আমলে নেওয়া হলে প্রায় দুই লাখ ৯০ হাজারই সরকারের উপবৃত্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে না শিক্ষার, না প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে তারা।


সংকটের শেকড় যেখানে
হিজড়াদের শিক্ষার মূল সংকট পরিবারে ও বিদ্যালয়ে। তাদের সবার জন্ম সমাজের দরিদ্র পরিবারে নয়। অনেকেই সচ্ছল ও বিত্তবান পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও শিকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ বঞ্চনার নেপথ্যে মূলত দায়ী পরিবারের অজ্ঞতা, অসহযোগিতা, সমাজে সম্মানহানির অমূলক ভীতি। আর বিদ্যালয়ে নেই তাদের উপযোগী পরিবেশ।


কাঁদে কেবল মা
রংপুরের হিজড়াদের সংগঠন ‘ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা’র সভাপতি হিজড়া আনোয়ারুল ইসলাম রানা বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো সর্বপ্রথম নিজ গৃহেই নিগৃহীত হন। আমরাও যে মানুষ, তা বোঝাতে যুদ্ধ করতে হয়। কেবল মা ছাড়া আর কেউ আমাদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদের কথিত ‘পারিবারিক ভবিষ্যৎ নিরাপদ’ পরিবেশের স্বার্থেই আমরা এমন বঞ্চনার শিকার। [ইত্তেফাক, ৩০ জুলাই, ২০২২]


হাফ লেডিস বলত সহপাঠীরা
যে দু-চারজন বিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন, তারাও চরম অসহযোগিতার শিকার হয়েছেন সহপাঠীদের দ্বারা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি শিক্ষকরাও। অবিরত বুলিংয়ের মতো নির্যাতন তাদের শিক্ষাবঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেরই একজন ভৈরবের মোসাম্মৎ মীরা জানান, শিশু বয়সে তার মধ্যে যখন মেয়েলি ভাব দেখা দেয়, তখন আশপাশের লোকজন তার পরিবারের সদস্যদের কটু কথা বলত। স্কুলে গেলে সহপাঠীরা হাফ লেডিস বলত। [ইত্তেফাক, ৩০ জুলাই, ২০২২]


আঁতকে ওঠার মতো পরিবেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এক তরুণ। দেখতে সুশ্রী ওই তরুণের আচরণে ছোটবেলা থেকেই নারীদের মতো কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই সহপাঠীদের মাধ্যমে যৌন নিগ্রহের শিকার হতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে অভিযোগ করতে গিয়ে শুধু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো আচরণের কারণে উল্টো তাকেই দোষারোপ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। [দেশ রূপান্তর, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০]


আইন নেই, আর্থিক সুবিধাও অপর্যাপ্ত
হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে দেশে কোনো ধরনের আইন প্রণয়ন না হলেও একটি নীতিমালা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সরকারিভাবে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিতে সরকার ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে এ নীতিমালা প্রণয়ন করে। শিক্ষাসহ হিজড়াদের জীবন-জীবিকার সংস্থানে ওই নীতিমালার বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক নয়। অন্যদিকে সমাজকল্যাণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের জন্য চার স্তরে উপবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সারা দেশে মোট ৫৭৪৫ হিজড়াকে বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে মাত্র ১২২৫ জনকে শিক্ষা উপবৃত্তি, ২৬০০ জনকে ভাতা ও ১৯২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।


সাফল্যের শিখর ছুঁতে পারেন তারাও
সঠিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পেলে হিজড়ারাও যে উচ্চ শিক্ষার মাইলফলক ছুঁতে পারেন দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ট্রান্সজেন্ডার সংবাদ উপস্থাপক হয়ে সেটা প্রমাণ করেছেন তাসনুভা আনান শিশির। উদাহরণ আরও আছে ২০১৮ সালে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান তানিশা ইয়াসমিন চৈতী। বর্তমানে তিনি ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’তে কর্মরত। এ ছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে কর্মরত হো চি মিন, ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরির পাশাপাশি প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ করছেন অঙ্কিতা, ব্র্যাক ব্যাংকে কমিউনিকেশন অফিসার সঞ্জীবনী, এনজিও ব্লাস্টের জুনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার শোভা সরকার, ‘সম্পর্কের নয় সেতু’র সভাপতি জয়া শিকদার, ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার জয়ী আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী, ‘বন্ধু’র লিয়াজোঁ কর্মকর্তা অনন্যা বণিক প্রমুখ হিজড়া। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। শিক্ষার সুযোগ ও পরিবেশ পাওয়ায় তারা এ সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছতে পেরেছেন। যদিও তাদের এ উত্তরণের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।


আশার আলোও আছে
উচ্চশিক্ষা স্তরে হিজড়াদের জন্য শিক্ষার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে সরকারের কাছে বিশেষ কোটা ব্যবস্থারও সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসিকে ধন্যবাদ জানায় হিজড়াদের সংগঠনগুলো। এ সুপারিশকে গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তাই নয়, হিজড়াদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালুর ঘোষণাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।


আমরা যা করতে পারি
পরিবার থেকে ছিটকে পড়ার পর অবহেলিত মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। সেখান থেকে তারা আর আলোয় ফিরতে পারে না। কিন্তু শুরুতেই পরিবার ও রাষ্ট্র সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে তারাও স্বাভাবিক জীবন পেতে পারে অন্য ১০ জন নাগরিকের মতো।


শেষ কথা
সৃষ্টিগতভাবে সব মানুষ নিখুঁত নয়। কোনো মানুষ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ার ক্ষেত্রে তার যেমন নিজের কোনো ভূমিকা থাকে না, তেমনি একজন মানুষ হিজড়া হওয়ার জন্যও সে নিজে দায়ী নয়। হিজড়াদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য সমাজের অন্যান্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বোধোদয় হওয়া অতি জরুরি।

https://www.shomoyeralo.com/details.php?id=212919

No comments:

Post a Comment