Tuesday, March 28

ঢাবির প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী অঙ্কিতা

শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন অঙ্কিতা ইসলাম। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী নারী হিসাবে সমাজে টিকে থাকতে অনেকেই স্রোতের সঙ্গে হারিয়ে গেছেন; কিন্তু ঠিক সেখানেই ইতিহাস গড়েছেন অঙ্কিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী হিসাবে প্রত্যাশা, প্রাপ্তি আর সংগ্রাম নিয়ে অঙ্কিতা ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুগান্তর প্রতিনিধি মাহাদী হাসান


ট্রান্সজেন্ডার বলতে কী বোঝায়

একজন রূপান্তরকামীর জেন্ডার তার জন্মসনদে থাকা লিঙ্গ পরিচয়ের চেয়ে ভিন্ন। শিশুকালে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমাদের স্ত্রী বা পুংলিঙ্গ হিসাবে রেকর্ড করা হয়। তবে কিছু মানুষ ক্রোমোজোম বা অন্য কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়, যা লিঙ্গ নির্ধারণের বিষয়টিকে জটিল করে ফেলে। এদের ইন্টারসেক্স (তৃতীয় লিঙ্গ) হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তির আচরণ, প্রত্যাশা ও বাহ্যিক প্রকাশের ওপর নির্ধারণ হয় তার জেন্ডার। সাধারণভাবে লিঙ্গের সঙ্গে জেন্ডারের মিল থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়।

জেন্ডার পরিচয় নির্ধারণ হয় ব্যক্তিগত ধারণার (আমরা নিজেদের দেখি ও বর্ণনা করি এবং বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের কীভাবে উপস্থাপন করি) ভিত্তিতে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কেউ স্ত্রী লিঙ্গের হয়েও নিজেকে পুরুষ হিসাবে পরিচয় দিতে পারেন। অন্যদিকে কেউ পুংলিঙ্গের হয়েও নারী পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেন। এ দ্বৈত পরিচয়ের বাইরে মানুষজন নিজেদের শুধু নারী বা পুরুষ হিসাবে পরিচয় করান না কিংবা তারা জেন্ডারের ক্ষেত্রে ভিন্ন পন্থায় আগান। যেসব মানুষ লিঙ্গ ও জেন্ডারের মধ্যে বৈসাদৃশ্য খুঁজে পান, তাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে জেন্ডার অসন্তোষ থাকা ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তারা কখনো কখনো নিজেদের ট্রান্সজেন্ডার বা ট্রান্স হিসাবে পরিচয় করান।

অঙ্কিতার জীবনের গল্প

সাধারণ শিশুর মতো জন্ম হলেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন বুঝতে পারেন ‘জাহিদুল ইসলাম’। ছোটবেলা থেকেই শাড়ি, চুড়ি পরতে ভালো লাগত তার। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে সংসার করবেন। তবে এ স্বপ্নের সঙ্গে সমানতালে চলতে থাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। তারপরও থেমে থাকেননি। গ্রাম থেকে উঠে আসা জাহিদুল ইসলাম রূপান্তরিত হয়ে এখন অঙ্কিতা ইসলাম। চাকরি করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

অঙ্কিতা তার ছোটবেলার সংগ্রামের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, আমার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায়। বেলায়েৎ হোসেন বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর ভর্তি হই টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত কলেজে। সেখান থেকে গণিতে স্নাতক পাশ করি। ছোটবেলা থেকে অনেক ভয় ও নির্যাতনের মধ্যে দিন কেটেছে। নিয়মিত যাতায়াত করতে পারিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কারণ, ছোটবেলা থেকে দৈহিকভাবে পুরুষের আকৃতি থাকলেও আমি নারীসুলভ আচরণ করতাম। আমার পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা ও মেয়েদের মতো সাজতে ভালো লাগত। আর এ বিষয়টিই আমার পরিবার কখনোই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। আমাকে পরিবার মানসিকভাবে সহযোগিতার পরিবর্তে বৈচিত্র্যময় আচরণের জন্য করা হতো মানসিক নির্যাতন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত বুলিংয়ের শিকার হওয়ার কথা বলতে গিয়ে অঙ্কিতা বলেন, আমার আচরণের কারণে শুধু পরিবার থেকেই অসহযোগিতা পাইনি; বরং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন গিয়েছি, তখন সহপাঠীদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। স্কুলে যাওয়ার পথে অপরিচিত মানুষও বুলিং করত। তখন ভাবতাম হয়তো বা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর এর পরিবর্তন আসবে। তবে স্কুলেও একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আর বয়ঃসন্ধিকালে সবচেয়ে বেশি বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। সহপাঠীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের দ্বারাও বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। তখন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম এবং স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে আবার নিজেকে স্বাভাবিক করেছিলাম।

ব্র্যাক ব্যাংকের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্নাতক পাশ করার পর ব্র্যাক ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিলে আমি আবেদন করি। তারা আমার পরিচয় জেনেও আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। এ ব্যাংকে চাকরি হওয়ার পর আমি নিজের পরিচয় প্রকাশের জন্য পরিবার থেকে বের হয়ে আসি। তবে এটি আমার পরিবার মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘ দেড় বছর পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে অনেক চেষ্টার পর সেটি স্বাভাবিক করেছি। আমি এখানে আমার জেন্ডার আইডেন্টি নিয়ে সম্মানের সঙ্গে অনেক স্বচ্ছ পরিবেশে কাজ করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে তিনি বলেন, আমার জীবনের অনেকটা সময় ট্রমার মধ্যে কাটিয়েছি। কারও সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না। পরিবার দরিদ্র থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারিনি। তবে চাকরি নেওয়ার পর মনে হলো মাস্টার্স করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তি দেখার পর আবেদন করি। ভাবছিলাম হবে না। আমাদের তো সব জায়গায় সুযোগ থাকে না। এখানে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পর পাশ করি। ভাইভার সময় ভয় করছিল। তবে মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষকরা অনেক আন্তরিক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ফি ছিল সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এটি দেখার পর ভাবছিলাম ভর্তি হতে পারব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান স্যার আমার অর্থ সংকটের কথা শুনে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে ঢাবিতে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার যে ধারণা তা বদলে দিয়েছে। এখানে সবাই আমাকে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে আমার পড়াশোনার জন্য শিক্ষকরা আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। আর সহপাঠীরাও সব ধরনের সহযোগিতা করেন।

ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বিষয়ে অঙ্কিতা বলেন, আমি মাস্টার্স শেষে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে চাই। একই সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির প্রায় ৯০ শতাংশই উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আমি তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে চাই।
https://www.jugantor.com/todays-paper/features/suranjona/659018/%E0%A6%A2%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE-%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%80-%E0%A6%85%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE?fbclid=IwAR2sFlvESWr69dqIl2FjIWHJ_K9nUHirQH4oLbRVyydoOU97p_SV6AS8Cnk

No comments:

Post a Comment