সমাজের কারও কারও কাছে জেন্ডারের প্রদত্ত ছক ভাঙাটা কোনো পছন্দ বা শখের বিষয় নয়, বরং নিজের মতো বাঁচার, আত্মপ্রকাশের তাগিদ। এমন যারা হয়, আমরা তাকে অসুস্থ, পাগল বা সমাজবিরোধী বলতে দ্বিধা করি না।
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের একটি গল্প। নাম ‘শরীফার গল্প’। গল্পের সারমর্ম: আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ এই বিভাজনের বাইরেও একটি শ্রেণি আছে, সমাজে এরা উপেক্ষিত, এদের ‘থার্ড জেন্ডার’ বা হিজড়া বলা হয়। আর দশজন মানুষের মতো ওদেরও অধিকার আছে। মূলকথা এটুকুই।
এই গল্পটিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের অগণিত কূপমণ্ডুক মানুষের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক। তিনি এক অনুষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণির বইয়ের ওই দুটি পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন এবং ট্রান্সজেন্ডারদের ‘সমকামী’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সবাইকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের বই ক্রয় করে ‘শরীফার গল্প’ এই দুই পাতা ছিঁড়ে ফেলতে আহ্বান জানিয়েছেন।
এই ভদ্রলোক সমাজে নারী-পুরুষের বাইরে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিতজনদের প্রতি একটা বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার উসকানিও দিয়েছেন।
দুনিয়ায় এমনিতেই ধর্মান্ধ মানুষের বাড়বাড়ন্ত। ঘুষ-দুর্নীতি-নারী নির্যাতনের চেয়েও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অন্যকিছু। তাদের জন্য এই শীতকালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ‘খণ্ড’ শিক্ষক দারুণ মহার্ঘ্য উপহার দিয়েছেন!
মোবাইল কিংবা ফেইসবুক ব্যবহারে আমরা অনেক এগিয়ে গেলেও আমাদের সমাজে প্রশ্ন করা, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা বা মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটেনি। ২০২৪ সালেও আমাদের মানসিকতার খোপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্ধকার হচ্ছে যৌনতার খুপরি ঘরটা। যৌনতা নিয়ে আমাদের ধারণা একেবারেই প্রথাবদ্ধ, ভুল আর অন্ধকারে ঠাসা। যৌনতার আলোচনাকে সবসময়ই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের মধ্যবিত্ত মানস প্রস্রাব-পায়খানা-ঋতুস্রাব-গর্ভপাতের কথা ইংরেজি ভাষায় ছাড়া বলে না, এমনকি ডাক্তারদেরও বলতে পারে না। এইসব বিষয়ে লেখালেখি দেখলেও স্কুল বালক-বালিকার ভয়ারিজম বা বালখিল্যসুলভ আকর্ষণের সঙ্গে একটা মানসিক বিকর্ষণ কাজ করে। অন্য দিকে বাঁধভাঙা উল্লাসে ‘ততটা-ভদ্র-হওয়ার-দায়-নেই’ এমন সমাজে চলে যৌন অভীপ্সার টানাপড়েন।
প্রচলিত বিশ্বাস ও ধর্ম বলে প্রতিটি মানুষই নারী-পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত। এদের যৌন প্রক্রিয়াও এক। অর্থাৎ নারীর সঙ্গে পুরুষের যৌনতাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা। এর বাইরে কিছু নেই, হতে পারে না।
‘ভিন্ন যৌনতার’ বিষয়টি আমাদের কাছে এখনো অচ্ছুত একটা ধারণা। যদিও আমাদের দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের অ্যাপ্লিকেশনে লেখা হচ্ছে নারী অথবা পুরুষের বাইরেও নিজের অন্য একটা যৌন পরিচয়, হিজড়া। কেউ এটাকে বলেন তৃতীয় লিঙ্গ।
ট্রান্সজেন্ডার শব্দটিই বলে দেয়, এটা লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের দেশে ‘তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি’-র জন্যও স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে।
কেউ কেউ বাংলায় ট্রান্সজেন্ডারকে রূপান্তরকামী হিসেবেও অভিহিত করেন। রূপান্তরকামী (পুরুষদেহে নারীমন বা নারীদেহে পুরুষমনের ধারক) এবং হিজড়া বা বৃহন্নলা (দৈহিকভাবেই পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী)— এই দুই বর্গই সারা বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে হিসেবে স্বীকৃত। সমকামী ও উভকামীদের সমস্যা লিঙ্গপরিচয়ের নয়। তাঁদের বিশিষ্টতা যৌন মনোভঙ্গি তথা পছন্দের বিষয়ে। যৌনতার মূলধারায় তাঁরা দলছুট, ফলে একঘরে। সমকামীদের মধ্যে কেউ ট্রান্সজেন্ডার হতেও পারেন। ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে কেউ সমকামী থাকতে পারেন। তাঁদের একত্রে এলজিবিটি বলে ডাকবার চলও আছে। কিন্তু তাতে এই শব্দগুলোর নিজস্ব গোত্রভেদ ঘুচে যায় না।
আমরা প্রত্যেকেই একটা জেন্ডার পরিচিতি নিয়ে বড় হয়ে উঠি। পরিচিতির এই বীজ বোনা হয়ে যায় আমাদের জন্মমুহূর্তেই; যখন নার্স শিশুর জড়ানো কাপড় সরিয়ে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজনকে বলেন, দেখে নিন ছেলে না মেয়ে; যখন সরকারি সিলমোহর পড়ে জন্মের সার্টিফিকেটের খোপে: পুং/স্ত্রী। এমনকী অস্পষ্ট যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মাল যে শিশু তাকেও এই দুটির কোনো একটি খোপে পুরে দেওয়া হয়। কিনে ফেলা হয় টিক দেওয়া খোপ অনুযায়ী জামাকাড়, খেলনা। এ বার আর প্রশ্ন নয়। এই স্থির খোপে আবদ্ধ হয়ে বড় হও, বাঁচো। গাছে উঠেছিস কেন, তুই কি ছেলে? পা ফাঁক করে বসিস না মা, লোকে খারাপ বলবে। ছোট প্যান্ট পরে ছেলেদের মাথা বিগড়ে দিয়ো না; সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকিস না, বিপদ হতে পারে। উল্টো দিকে, এ মা, বেটাছেলে হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছিস? বোনের জামাকাপড় পরেছিস কেন, তুই কি হিজড়া সাজতে চাস? ছেলে হয়ে নাচ শেখার বায়না কোরো না, বন্ধুরা লেডিস বলবে।
জন্মের আগেই ঠিক হয়ে থাকা এ এক আদর্শ অলঙ্ঘ্য অবশ্যপালনীয় ভূমিকা। এ আবার কী? পুরুষালি বা মেয়েলি, এই সামাজিক ভূমিকায় কিছুটা এদিক ওদিক সহ্য করা হয়, যদি তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু খোপের নিয়ম না মেনে যদি বেচাল হও, যদি লাইন টপকাও, যদি খোপ ভাঙার সাহস দেখাও, তা হলেই তুমি বিকৃত, অসহ্য, সন্দেহজনক তুমি পতিত। তাই প্রান্তে থাকো, সুযোগসুবিধা চেয়ো না, চোখের সামনে এসো না। এলে বরাদ্দ চোখরাঙানি, বাড়াবাড়ি করলেই উত্তমমধ্যম।
আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই খোপের এই বেঁধে দেওয়া আচরণবিধি মেনে নিয়ে দিব্যি সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিলেও অনেকেই বিদ্রোহ করে বসে। নিজের ওপর চেপে বসা জেন্ডার পরিচিতির অলঙ্ঘ্যতা মেনে না নিয়ে ‘বিপরীত’ সেক্স নির্ধারিত জেন্ডারের ভূমিকায় ও আচার-আচরণে তাদের অনায়াস যাতায়াত দেখায় যে, নারী ও পুরুষ দুটি পরস্পর বিপরীত অটুট জল-অচল বর্গ নয়।
যারা নারী বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সুখে থাকে, তারা অনেকেই রান্না করতে বা নাচতে ভালোবাসে, আবেগপ্রবণ হয়ে প্রকাশ্যে সশব্দে কেঁদেও ফেলে। আবার অনেকে ধূমপান করে, ‘ছেলেদের মতো’ চুলের ছোট ছাঁট দিয়ে বাইক চেপে উদ্দাম হতে চায়। অন্য দিকে, যারা ‘পুং’ খোপে টিক দিয়ে আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই মন দিয়ে রাঁধতে ভালবাসে, ‘মেয়েদের মতো’ নাচতে-গাইতে চায়, সেজেগুজে নিজেকে সুন্দর দেখতে চায় বা সোফায় পা ছড়িয়ে বসায় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। একইসঙ্গে হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দুঃসাহসিক হয়ে ওঠে, জমিয়ে ফুটবল খেলে, আবার বৈবাহিক জীবনেও সুখী থাকে। জেন্ডার বহিঃপ্রকাশের এমনই সহনীয় গণ্ডির মধ্যে আমাদের বিচরণ। আমরা চাই না আমাদের আচরণ বা প্রকাশগুলোতে সব সময় পুং/স্ত্রী এই দুই বিধিবদ্ধ জেন্ডার ভূমিকার তকমা সেঁটে যাক; চাই না সমাজ আমাদের বিকৃত বলুক বা ‘সবই পশ্চিমী সংস্কৃতি বা বিশ্বায়নের ফল’ বলে আক্ষেপ করুক বা মস্করা করুক।
উল্লেখ্য, যৌন প্রবৃত্তি বা বিভিন্ন ধরনের যৌন বৈশিষ্ট্য লালনকারীদের সমাজে নানা নামে ডাকা হয়। গত শতকের শেষ দিকে ‘যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়-ভিত্তিক সংস্কৃতিগুলির’ বৈচিত্র্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার জন্য ‘এলজিবিটি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সামগ্রিকভাবে ‘এলজিবিটি’ বলতে বোঝায় ‘লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার’ অর্থাৎ, নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের যৌন বৈশিষ্ট্যের মানুষ আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে এলজিবিটি। L=Lesbian (নারী+নারী বা নারী সমকামী), G=Gay (পুরুষ+পুরুষ বা পুরুষ সমকামী), B= Bisexual man/women (বাইসেক্সুয়াল বা উভকামী), T=Transman/women (ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী)। এছাড়াও ইন্টারসেক্স (Intersex) বা অন্তবর্তী, কিঙ্কি (Kingky) বা বিচিত্রকামী বা কোতি, ক্যুইয়ার (Quier) বা প্রথাবিরোধী যৌন লিঙ্গ পরিচয়ধারী, CIS Women (মেয়ে মেয়ের প্রেমে পড়ে, মেয়ে হতে না চাওয়া সমকামী মেয়ে, যারা খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন) ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন যৌন পরিচয়ে পরিচিত মানুষ দেখা যায়। এই ধরনের অন্তর্ভুক্তির স্বীকৃতি হিসেবে আদ্যক্ষরটির একটি জনপ্রিয় পাঠান্তরে ইংরেজি “কিউ” (Q) অক্ষরটি যুক্ত করা হয় যৌনপ্রবৃত্তির স্থলে কুইয়্যার বা কোয়েশ্চেনিং (প্রশ্নরত) বোঝাতে (অর্থাৎ, ‘এলজিবিটিকিউ’), ১৯৯৬ সাল থেকে নথিভুক্ত।
সমকামিতার সমর্থকরা মনে করেন, সমকামিতা অস্বাভাবিক নয়, এটি কোনও ধরনের জীবনচর্চার সমস্যা নয়, বিকৃত মনোভাবও নয়। আর পাঁচজন মানুষ যে রকম ডান হাতি বা বাঁ হাতি হন, কিংবা খর্বকায় বা লম্বা হন এগুলো যেমন স্বাভাবিক, কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেন না, এ ক্ষেত্রেও তাই। কেউ নিজে এই আচরণের জন্য দায়ী নন।
সমাজের কারও কারও কাছে জেন্ডারের প্রদত্ত ছক ভাঙাটা কোনো পছন্দ বা শখের বিষয় নয়, বরং নিজের মতো বাঁচার, আত্মপ্রকাশের তাগিদ। এমন যারা হয়, আমরা তাকে অসুস্থ, পাগল বা সমাজবিরোধী বলতে দ্বিধা করি না। আমরা খুঁজে দেখি না তার এই আকাঙ্ক্ষার জৈবিক, সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
বিজ্ঞান এবং সাধারণ বুদ্ধি, দুই-ই বলে যে, মানুষ নামক প্রজাতির দুটি সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ: পুরুষ বা স্ত্রী। এই দুই শরীর যৌনাঙ্গ, ক্রোমোজোম, হরমোন, মস্তিষ্কের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের তফাত নিয়ে জন্মায় এবং তাদের জেন্ডার বা সামাজিক লিঙ্গও সেই অনুসারেই বিবর্তিত হয়। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিনতায় কেউ নিজেকে কোন জেন্ডারের সঙ্গে কতটা একাত্ম বলে মনে করবে, বিজ্ঞান কিংবা সামাজিক পরিমণ্ডল কেউই সেটা ঠিক করে দিতে পারে না। ক্রোমোজোম, হরমোন, পরিবেশের প্রভাবকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, একটি শিশু অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের নানান উদ্দীপনায় সাড়া দিতে দিতেই নিজের সত্তাকে খুঁজে পায়, জেন্ডার পরিচয় যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ এক জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া।
https://bangla.bdnews24.com/opinion/nb3gktgiiz
No comments:
Post a Comment