সম্প্রতি পাঠ্যবইয়ে জেন্ডার বৈচিত্র্য বিষয়ক পাঠের একাংশ বাতিলের দাবি জানিয়ে রোষানলে পড়েছেন জনৈক ব্যক্তি। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিষয়ে একটি ক্লাস নিয়েছিলেন। পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ করার পর ব্র্যাক থেকে তার ক্লাস নেয়া বাতিল করা হয়। এতে আবার ব্র্যাক ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন কেউ কেউ। অনেকের অভিযোগ, পাঠ্যবইয়ের উক্ত অংশে হিজড়া সম্প্রদায় শুধু নয়, সমকামী ব্যক্তিদেরও নির্শেশ করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশের মানুষদের মধ্যে যত মত, তার চেয়ে বেশি বিভ্রান্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। সব ব্যাপারেই চলছে বাড়াবাড়ি, অস্থিরতা ও উগ্রতা।
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ওই অংশটি মূলত ইন্টারসেক্স বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিষয়ে শিশু-কিশোরদের মনে গ্রহণযোগ্যতা ও সহমর্মিতাকে উৎসাহিত করার জন্য যুক্ত করা হয়েছে। হিজড়াদের সামাজিক অন্তর্ভূক্তিকরণে জনমনে উল্লেখযোগ্য কোনো আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বইয়ে জেন্ডার বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে সমকামিতাকে উসকে দেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছেÑএমন একটি প্রচার চাউর করা হয়েছে। আর এ নিয়েই মূল দুশ্চিন্তা। স্বাভাবিকভাবেই, সমকামিতা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলসানের দেশে প্রচলিত ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থি। ফলে স্কুলে বাচ্চাকে কী পড়ানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের মতামতের মূল্য থাকবে। তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মনীতির পরিপন্থি কিছু বাচ্চাদের শেখানো হলে তারা আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া বাংলাদেশে সমকামিতা আইনত অপরাধ। পেনাল কোড ১৮৬০-এর ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু আলোচ্য পাঠ্যবইয়ে আদৌ কি সমকামিতার প্রতি ন্যূনতম ইঙ্গিত করা হয়েছে?
‘ছেলে হলেও নিজেকে মেয়ে মনে হয়’ এ কথাটি ট্রান্সজেন্ডার ও ইন্টারসেক্স উভয়ের ক্ষেত্রেই খাটে। ‘হিজড়া’ একটি উপমহাদেশীয় টার্ম। কোনো ব্যক্তির জš§গতভাবে প্রাপ্ত ও বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান জননাঙ্গের সঙ্গে শরীরের ভেতরের অংশের মিল থাকে না বা তাকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না, তাকে এ অঞ্চলে হিজড়া বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জšে§র সময় দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখে এ শিশুদের চিহ্নিত করা যায়। অনেক বাবা-মায়েরা এমন শিশুকে হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে দিয়ে দেন। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবনযাপন, শিক্ষা ও পেশা বাছাইয়ের সুযোগ তাদের অনেক কম। উপরন্তু, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনার কারণে আরও কোণঠাসা হয়ে থাকে তারা।
আবার কারও কারও ক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে দৃশমান ভিন্নতা না থাকলেও জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে তারা ভিন্ন লিঙ্গের হতে পারে। যখন কেউ তার জš§গতভাবে প্রাপ্ত ও বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান জেন্ডার নিয়ে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষে ভোগে, তাকে বলে জেন্ডার ডিসফোরিয়া। রক্ষণশীল সমাজ হওয়ায় জেন্ডার ডিসফোরিয়া নিয়ে আমাদের ধারণা কম। কারও মতে এটা মানসিক বিকৃতি, যার চিকিৎসা করা উচিত। কেউ বলছেন, এসব পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা যা কঠোরভাবে প্রতিহত করা উচিত। নিজস্ব যুক্তি বা ধারণা যেমনই হোক, ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া ব্যক্তিরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের বাতিল করতে চাওয়া বা তাদের অধিকার খর্ব করা কোনো সভ্য মানুষের কাজ নয়।
প্রথমত, ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা কোনো পশ্চিমা আমদানি নয়। শরীরে এক, কিন্তু মনে আরেক লিঙ্গের মানুষ পৃথিবীতে সবকালেই ছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমরা সারা পৃথিবীর সবার মনের খবর জানতে পারি, নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করতে পারি। এজন্য জেন্ডার ডিসফোরিয়ার ধারণাকে বিদেশি আমদানি মনে হলেও তা ঠিক নয়। কেন ও কীভাবে একজন মানুষ শরীরে এক জেন্ডারের, কিন্তু মনে ও অনুভূতিতে তার বিপরীত হন, তার রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আমরা জানি, একজন হিজড়া ব্যক্তি জš§গতভাবে শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তাদের যৌনাঙ্গের বাইরের দিকের সঙ্গে ভেতরের অংশের মিল থাকে না। অর্থাৎ এমন হতে পারে যে, ছেলেদের ক্ষেত্রে যেমন শুক্রাশয় ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থাকার কথা, তেমনটি থাকে না। এ ধরনের শারীরিক অবস্থাকে বলা হয় ডিজঅর্ডারস অভ সেক্স ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি) বা যৌন বিকাশ ব্যাধি।
এ ধরনের ডিসঅর্ডার ক্রোমোজমের বিন্যাসের ভিন্নতা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতাসহ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আমরা জানি, শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতরে থাকা ক্রোমোসমের সেট আমাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। কিন্তু যদি একজন ব্যক্তির ৪৬,ঢঢ ডিজঅর্ডার থাকে (নারীদের মতো), কিন্তু শরীরের বহির্ভাগে পুরুষ জননাঙ্গ থাকে, তাহলে তিনি পুরোপুরি নারী বা পুরুষ লিঙ্গের হবেন না। অর্থাৎ বাইরে থেকে তাকে পুরুষ মনে হলেও জেনেটিক প্রোফাইলের দিক থেকে তিনি নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিদের নারীদের মতো স্বাভাবিক জরায়ু ও ফেলোপিয়ান টিউব থাকে।
আবার, ৪৬ঢণ ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। কোনো ব্যক্তির ঢণ ক্রোমোসম (যা পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ করে) থাকলেও শরীরের জননাঙ্গ মেয়েদের মতো। শরীরের ভিতরের দিকে শুক্রাশয় থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে দেখতে মেয়েদের মতো হলেও জেনেটিকভাবে তিনি পুরুষ।
আবার এ ডিজঅর্ডার এমনও হতে পারে যে, একই ব্যক্তির শরীরে ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় দুই ধরনের টিস্যুই বিদ্যমান। আবার ক্রোমোসমের রূপরেখা এমনও হতে পারে যে, ব্যক্তির লিঙ্গনির্ধারণকারী ক্রোমোজম (সেক্স ক্রোমোজম) হয় একটা কম থাকে বা একটা বেশি থাকে। এক্ষেত্রে জননাঙ্গের পরিবর্তন না হলেও শুধু জিনগত ও হরমোনের ভারসাম্যে ভিন্নতার কারণে সমস্যা হতে পারে।
তার মানে হলো, আমরা যে প্রাকৃতিক বা বাইনারি জেন্ডার ধারণায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তার বাইরেও বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কারণে বিভিন্ন জেন্ডারের মানুষ থাকতে পারেন। এটা জিনগত বা শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার, মানসিক বৈকল্য বা বিকৃতি নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদের সেভাবেই তৈরি করেছেন।
ক্রোমোসম প্রোফাইল অপরিবর্তনীয়। তাই আগে জেন্ডার ডিজঅর্ডার আছে এমন ব্যক্তিদের নারী বা পুরুষ যে কোনো একটি লিঙ্গ বেছে নিতে হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাইরের দিকের জননাঙ্গের সঙ্গে মিল রেখে ভেতরের অংশ পরিবর্তন করা হতো। এক্ষেত্রে ক্রোমোসম কনফিগারেশনকে আমলে নেয়া হতো না, ফলে সমস্যা থেকেই যেত। আর ব্যক্তিকে জেন্ডার নিয়ে হতাশা বা ডিসফোরিয়ায় ভুগতে হতো। ক্রোমোসম বাদেও মনস্তাত্ত্বিক, স্নায়বিক ও আচরণিক অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে, যা একজন মানুষের জেন্ডার পরিচয়কে প্রভাবিত করে। এসবের ওপর নির্ভর করে তিনি কোন জেন্ডারের মানুষ, তা তার শরীরের অ্যানাটমি বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমনই হোক না কেন।
আর যাদের আপাতদৃষ্টে বাহ্যিকভাবে শারীরিক কোনো পরিবর্তন থাকে না, তাদের ডিসঅর্ডার জšে§র সময় বা শৈশবে বোঝা যায় নাÑএকটু বড় হলে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে তাদের আচরণ ও শরীরের সঙ্গে মনের বোঝাপড়ার সমস্যা থেকে বোঝা যায়। বিভিন্ন ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমেও হরমোন ও জিনগত ভিন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কতজন অভিভাবকের তা করার সামর্থ্য ও জ্ঞান আছে? ফলে এ ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় এ বাচ্চারা ও তাদের অভিভাবকেরা বিপাকে পড়েন।
এতক্ষণ যা কিছু আলোচনা করা হলো তা সবই জেন্ডার পরিচয়-সংক্রান্ত বিষয়। সমকামিতার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। সমকামিতা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের ব্যাপার। তবে কোনো জেনেটিক বা হরমোনের প্রভাবে কোনো ব্যক্তি সমকামি হন কি না বা সমকামিতার প্রতি ঝুঁকে পড়েন কিনা, তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে এখনও গবেষণা চলছে। তাহলে কোনো ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পুরুষ বলে মনে হলেও তার জেনেটিকস ও হরমোন যদি মেয়েদের মতো হয়, তাহলে তার নিজেকে ‘মনে মনে মেয়ে’ অনুভূত হওয়ারই কথা। একই ভাবে সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার পক্ষে নারীদের প্রতি নয়, পুরুষদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করাও খুব স্বাভাবিক। অথচ বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে তিনি পুরুষ হয়ে পুরুষের প্রতি আকর্ষিত বা সমকামী। অথচ সমকামী হওয়ার জন্য ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। একজন ভেতরে ও বাইরে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ বা নারী সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হলো, হিজড়া বা ইন্টারসেক্স ব্যক্তিদের বিষয়ে আলোচনা শিশুকিশোরদের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন আছে কি না। অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কারণ শিশুদের যদি শেখানো হয় যে, একজন মানুষ দেখতে ছেলে বা মেয়েদের মতো হলেও সে তার বিপরীত হতে পারে, অর্থাৎ তার জেনেটিক জেন্ডার ভিন্ন হতে পারে, তাহলে সে বুঝবে যে সে নিজে বা তার কোনো সহপাঠী এমন পরিস্থিতিতে পড়তেই পারে। এতে হীনম্মন্যতায় ভোগা বা উপহাস ও অবজ্ঞা করার কোনো কারণ নেই।
আমাদের মেনে নিতে হবে, জন্ম থেকেই কাউকে হিজড়া হিসেবে চিহ্নিত করা নাও হতে পারে। এই হিজড়া (ইন্টারসেক্স) ব্যক্তিদের অনেকেই হয়তো শুধু সামর্থ্যরে অভাবে ডাক্তারি পরীক্ষা ও সার্জারি করে কোনো একটা নির্দিষ্ট জেন্ডারে যেতে পারেননি বলেই হিজড়া থেকে গেছেন। ২০১৩ সালে আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ১০ বছরে এ জনগোষ্ঠীর অনেকে স্বাভাবিক পেশায় এসে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগই আগের মতোই প্রান্তিক অবস্থায় আছেন। সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন তারা। তাদের প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা দূর করতে হবে। যাতে তারা দেশের নাগরিক হিসেবে সব রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ ও সহযোগিতা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজ শুধু সরকারের নয়, সমাজের সবার। মূলত সামাজিক সহমর্মিতাই তাদের ডিসফোরিয়া বা হতাশা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্ধুদ্ধ করবে এবং তারা নিজেদের মেনে নেয়ার শক্তি পাবে।
No comments:
Post a Comment