Tuesday, March 19

অন্তরালেই থাকতে চান হিজড়া মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার রনি

দেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে লড়েছে সব শ্রেণী-পেশা আর ধর্মের মানুষ। কিন্তু স্বাধীন সে দেশে সবাই কি পেয়েছে সমান সম্মান? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ার নীরব বেদনা নিয়ে ঘুরছেন হিজড়া গেরিলাযোদ্ধা মাস্টার রনি। যুদ্ধে এই মানুষগুলোরও ছিলো অবদান। 

একাত্তরের ক্যামেরায় বলেছেন তার যুদ্ধদিনের ঘটনা ও লোকচক্ষুর অন্তরালের জীবনের অপ্রাপ্তির সব গল্প। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতার পর সেই দেশে আপন সমাজে ফিরতে পারেননি গেরিলা যোদ্ধা মাস্টার রনি। সমাজের প্রচলিত লিঙ্গ পরিচয়ের ধারণা তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে পরিবার থেকে। অভিমানে নিজের সমাজ ছেড়ে চলে আসন সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর কাছে। এরপর ৫০ বছর ছিলেন আড়ালে। সেই আড়াল কাটিয়ে তার সামনে একাত্তর।

একাত্তরের মার্চে দেশের সব অঞ্চলের মতোই, স্বাধীনতার ঢাক পৌঁছে যায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নির্ভয়পুর গ্রামে। অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা, আবদুল হালিম বেলাল নামের ২১ বছরের যুবকের মনেও দোলা দিয়ে যায় মুক্তির ডাক। শারীরিক অবয়ব পুরুষালি হলেও হাঁটাচলা, কথাবার্তায় ছিল মেয়েলি ঢং। 


কিন্তু নিদারুণ সেই যুদ্ধের সময় এত কিছু ভাবার সময় কোথায়? ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করে ঢাকা। এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে কুমিল্লায়ও হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। যুবক বেলাল পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতে। সেখান থেকে সমবয়সীদের সঙ্গে দেশমাতৃকার ডাকে নাম লেখান মুক্তিবাহিনীর দলে। বাবার অমতে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে যোগ দেন যুদ্ধে ।

মাস্টার রনি বলেন, মুক্তিবাহিনীতে আমরা যারা নাম লিখিয়েছিলাম, তাদের প্রথমে নেয়া হয়েছিল ভারতের রাজনগর ক্যাম্পে। সেখানে কিছুদিন প্রশিক্ষণের পর নেয়া হলো আগরতলার কাছাকাছি চরিলাম এলাকার একটি ক্যাম্পে। সেখানেও কিছুদিন ট্রেনিং শেষে পাঠিয়ে দেয়া হয় আসামের লায়লাপুরে। সেখানে ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে চলে আসি মেলাঘর ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টারে। সেই ক্যাম্পের নেতৃত্বেই যুদ্ধ করেছিলাম।


একাত্তরে আসামে ট্রেনিং শেষে জীবন বাজি রেখে দু’নম্বর সেক্টরের অধীনে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন বেশ কিছু অপারেশনে। শত্রুর ওপর অতর্কিত হামলা চালাতেন তাঁরা, সব তছনছ করে দিতেন। প্রথম অপারেশন ছিল কুমিল্লার নির্ভয়পুরে। ওই অপারেশনে গিয়ে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন সহযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্যাম্প থেকে বলা হয়, আমরা যেহেতু বয়সে তরুণ, অভিজ্ঞতাও কম তাই আমাদের পাঠানো হবে নিজ নিজ গ্রামে বা কুমিল্লার চেনাজানা এলাকাগুলোয়। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি।

নির্ভয়পুরে যুদ্ধকালীন খাবার আর বিশ্রামের জন্য ভুল করে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাজাকারের বাড়িতে। তবে নির্ভয়পুরের সেই অপারেশন এখনও মাস্টার রনিকে নাড়া দিয়ে যায়। বলেন নির্ভয়পুরের অপারেশনে তিন দিন উপোস ছিলাম সবাই। সকাল নাগাদ এক বাড়িতে গিয়ে খাবার চাইলাম। বাড়ির মুরুব্বিকে জানালাম আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি। তিনি সব শুনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। মুরগি জবাই দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা হলো। এরপর লোকটি আমাদের জন্য একটু পান আর ধূমপানের ব্যবস্থা করতে বাজারে যায়। 


যাবার আগে বলে যায়, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। তিনি চলে যাওয়ার পর তার কিশোর বয়সী মেয়ে এসে আমাদের বলে, আপনারা কি জানেন আমার বাবা কে? তিনি কোথায় গিয়েছেন? তিনি শান্তিবাহিনীর সদস্য। পাকিস্তানি ক্যাম্পে গেছেন আপনাদের বিষয়ে জানাতে। আপনারা খাবেন না জীবন বাঁচাতে পালাবেন। আমরা দেরি না করে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে অবস্থান নিই। 

দেখতে চেয়েছিলাম মানুষটি আসলেই রাজাকার কি না। ঘণ্টাখানেক পর দেখি সত্যিই তো, লোকটি পাক সেনাদের নিয়ে তার বাড়ির দিকে আসছে। তখন আমরা আক্রমণ করি। ওই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে আসার পর ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করি, মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল এসে লোকটিকে নিয়ে যায়। মেয়েটি তখন তার বাবাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল অনেক। কিন্তু তাকে তখন তার নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।


গেরিলা কায়দায় ছদ্মবেশে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে থেকে তথ্য সংগ্রহ ও মানচিত্র তৈরির কাজও করেছেন বেলাল। হিজড়া হিসেবে যে গান পারতেন তাও কাজে লেগেছিলো পাকিস্তানি ক্যাম্পের সেনাদের চোখ ফাঁকি দিতে। গেরিলা যোদ্ধাদের প্রতিটি অভিযানই হতো সাহসিকতায় পূর্ণ। এমনই এক দুঃসাহসিক অভিযানে গিয়েছিলেন মাস্টার রনি। তা-ও আবার একা। 

রাধানগর ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন মুখার্জি। তিনি একদিন আমাদের প্লাটুনের ৩০-৩৫ জনকে ডেকে বললেন চৌদ্দগ্রাম আর্মি ক্যাম্পের ম্যাপ করে আনতে হবে। কে যেতে পারবে? বড়ই ভয়ানক কাজ। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। কেউ রাজি হচ্ছিল না। আমি তখন বললাম, আমি যেতে চাই। কিন্তু ম্যাপ আকারে আনতে পারব না। ক্যাম্পের কোথায় কী আছে এসব বিষয় দেখে এসে জানাতে পারব। 

ক্যাপ্টেন মুখার্জি রাজি হলেন। আমি তখন দেশে প্রবেশ করে নানাবাড়ি চলে যাই। নানাকে গিয়ে বললাম এ বিষয় জানালাম। বললাম এলাকার একজন রাজাকারকে ডেকে এনে দিতে। তার সহযোগিতা লাগবে। তিন দিন লুকিয়ে ছিলাম নানাবাড়ি। তিন দিন পর নানা এক রাজাকারকে নিয়ে এলেন। 


যাকে আনলেন সে আমার সহপাঠী, স্কুলের বন্ধু! বন্ধুকে পেয়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালে সে বলল, আমি রাজাকারে নাম লিখিয়েছি জীবন বাঁচানোর জন্য, আমার পরিবার, আমার গ্রাম বাঁচানোর জন্য। আমি তোকে এ কাজে সাহায্য করব। ওই বন্ধুর সঙ্গে তখন ওদের ক্যাম্পে যাই। চলনে-বলনে মেয়েলিভাব ছিল আমার, নাচগানও পারি। ক্যাম্পে গিয়ে ওদের ক্যাপ্টেনকে বললাম, আমি তোমাদের নাচগান শোনাব! 

তিনিও মজা পেয়ে রাজি হলেন। ওই সন্ধ্যায় কয়েকটি উর্দুগান গেয়ে নাচলাম। সবাই খুশি হলো। তখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পে যাই, সব দেখে এসে ক্যাপ্টেন মুখার্জির কাছে রিপোর্ট করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, চৌদ্দগ্রাম পাকিস্তানি ক্যাম্প দখলের পর মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় আর্মির সঙ্গে আমাকে দেখে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ‘তু গাদ্দার হ্যায়’ বলে চিল্লাতে লাগলেন। আমিও তাকে বলেছি, তুমি আমার দেশ দখল করতে চেয়েছ। আমি আমার দেশ মুক্ত করতেই এ কাজ করেছি। আমি গাদ্দার নই। তুমি গাদ্দার।মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মূল্যবোধ

লিঙ্গ পরিচয়ে অন্যদের চেয়ে আলাদা। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় চলে আসতে হয় তাকে। সেই থেকে তিনি ৫০ বছর পরিবার আত্মীয়-স্বজন এবং চেনা–পরিচিতের কাছে নিখোঁজ অথবা মৃত ছিলেন। টাকার জন্য টিউশনি করতেন, তাই নামের আগে মাস্টার শব্দটা যোগ হয়। আবদুল হালিম বেলাল হয়ে যান রনি হিজড়া ওরফে মাস্টার রনি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে তার নেই কোনো দুঃখবোধ। 

গর্বের সঙ্গেই বলেন ‘আমি হিজড়া আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা’। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। ঢাকায় বাসা বদলের কোনো এক ফাঁকে হারিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আর কাগজপত্র। সেই সার্টিফিকেট উদ্ধারে নেননি কোনো উদ্যোগ। নিজের মতো করেই থাকতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।

জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তরুণ মাস্টার রনি।যে জীবনের তোয়াক্কা না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আজ ৭৩ বছর বয়সে, সেই জীবন সায়াহ্নে আবদুল হালিম বেলালের চাওয়া। যে লাল সবুজ পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তা মুড়িয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা যেন দেয়া হয় শেষযাত্রায়। আর চান মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে যেন শেষশয্যাটা হয়।

No comments:

Post a Comment